ঢাকা রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বান্দাইখাড়ায় শতাধিক নিরীহ মানুষকে ব্রাশফায়ারে হত্যা

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৫৬ এএম
ছবি: আনন্দবাজার

১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এই দিনে দিল্লিতে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ২৫টি দেশের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘে বাংলাদেশের জনগণের দাবি তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়াও, দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক মহলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে সংঘটিত হয়। নিম্নে এই দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো সুসংবদ্ধভাবে উপস্থাপন করা হলো।

দিল্লি আন্তর্জাতিক সম্মেলন

১৯ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ৪৫টি দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিভিন্ন কমিশনে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। এই সম্মেলনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপিত হয়:

জাতিসংঘে বাংলাদেশের দাবি উত্থাপন: ২৫টি দেশের প্রতিনিধিরা ঘোষণা করেন যে তারা জাতিসংঘে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবি তুলে ধরবেন। এই প্রস্তাবে সম্মেলনে গঠিত কমিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

পদযাত্রার প্রস্তাব: কমিশনের প্রধান স্যার সেনার্থ গুনবর্ধনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের কাবুল থেকে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত একটি পদযাত্রার আয়োজনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এই পদযাত্রার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

বাংলাদেশ পরিদর্শন: ডেনমার্কের এমপি নিয়েলসনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে এবং সেখানকার পরিস্থিতি স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

শরণার্থী শিবির পরিদর্শন: কমিশনের সদস্যরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন এবং শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অবস্থার উপর প্রতিবেদন তৈরি করবেন।

পাকিস্তানের ঘটনাবলি

১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে:

মাহমুদ আলীর বক্তব্য: করাচিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি মাহমুদ আলী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সেনাবাহিনীর তৎপরতা এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেনি যার জন্য ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে।”

উপ-নির্বাচনের ঘোষণা: পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে যে, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৭৮টি শূন্য আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১০৫টি শূন্য আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া

১৯ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়:

জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের বিবৃতি: জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এক বিবৃতিতে বলেন, “বর্তমানে কেবল পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একত্রে বৈঠকে বসতে হবে। পাকিস্তান যদিও এটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে দাবি করে, এটি আদতে আঞ্চলিক শান্তির জন্য হুমকি এবং পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক বিপর্যয়কে আরও দীর্ঘায়িত করছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা কতটা বাস্তবসম্মত তা প্রশ্নবিদ্ধ। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শরণার্থীরা ফিরবে না, কারণ তারা প্রাণ বাঁচাতেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। পাকিস্তান সরকারের উচিত উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, কারণ এই সমস্যার জন্য তারাই দায়ী।”

বিবিসি’র প্রতিবেদন: বিবিসি’র একটি সংবাদে বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, “রাজনৈতিক মীমাংসা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।” তিনি অপ্রতুল সাহায্যের কথা উল্লেখ করে বিশ্ববাসীর কাছে আরও সাহায্যের আহ্বান জানান।

দেশব্যাপী গণহত্যা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় নওগাঁর আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়ায় গণহত্যা চালায়। তারা নৌকায় করে আত্রাই নদীপথে বান্দাইখাড়া বাজারে পৌঁছে প্রায় ৩৫০ জন মানুষকে আটক করে। এরপর তাদের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে বাজারের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় লাইনে দাঁড় করানো হয়। হানাদার বাহিনী নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়, ঘরবাড়ি লুটপাট করে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ব্রাশফায়ারে শতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। তবে গুরুতর আহত অবস্থায় ৮ জন গ্রামবাসী প্রাণে বেঁচে যান।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অভিযানের বিবরণ দেওয়া হলো:

লক্ষ্মীপুর: রামগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুরে ১০টি জিপে করে আসা হানাদার বাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারির নেতৃত্বে মীরগঞ্জ ও ফজলচাঁদ হাটে অতর্কিত হামলা চালানো হয়। প্রায় ৯ ঘণ্টা যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

কুমিল্লা: চৌদ্দগ্রামের বাতিসা ইউনিয়নে লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে গোবিন্দমানিক্য দীঘিতে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এতে দুটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং ৬ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। এছাড়াও, বাতিসা বাজার ঘাঁটিতে আক্রমণে ৬টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়, ২০ জন হানাদার সৈন্য নিহত এবং ১২ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর দুজন যোদ্ধা আহত হন।

ময়মনসিংহ: ভালুকার রাজৈগ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লুটপাটের সময় আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এতে ৭ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং প্রায় দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। একই দিন পোনাশাইল এলাকায় চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ও হানাদারদের সঙ্গে গুলি বিনিময় করে, যাতে ২ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

২ নম্বর সেক্টর: মালোচিন বাজারে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল হানাদার পুলিশের উপর আক্রমণ চালায়। এতে ১৯ জন হানাদার পুলিশ নিহত এবং ৩ জন আহত হয়।

যশোর: বোয়ালিয়া বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহে আক্রমণ চালায়। চার দিনব্যাপী এই যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ৩ জন গ্রামবাসী শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

লক্ষ্মীপুরে রকেট হামলা: মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে রকেট লঞ্চার দিয়ে হামলা চালায়, যাতে দুটি বাঙ্কার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ২ জন হানাদার সৈন্য নিহত ও ১ জন আহত হয়।

বগুড়া: সারিয়াকান্দির তাজুরপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালানো হয়। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

৮ নম্বর সেক্টর: গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনী মোহাম্মদপুর অবস্থানে আক্রমণ চালায়, যাতে একজন মেজরসহ ৬ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

দিনাজপুর: অমরখানায় মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়, যাতে ৮ জন হানাদার সৈন্য নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

সূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (সপ্তম, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড)

দৈনিক পাকিস্তান, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

দ্য গার্ডিয়ান, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০