ঢাকা শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ২৪ কার্তিক ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০৬ এএম
ছবি: আনন্দবাজার

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৫ সেপ্টেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এই দিনটি মুক্তিসংগ্রামের ষষ্ঠ মাস উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী ভাষণ দেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা এখন সর্বত্র বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য। ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনীর বহরে বিমান ও জাহাজ যুক্ত হয়েছে।”

এদিকে, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী তাঁর বক্তব্যে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীতে প্রতিনিয়ত নতুন মুক্তিযোদ্ধারা যুক্ত হচ্ছেন এবং সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনী হানাদারদের পর্যদস্ত করে ফেলেছে।

ঢাকায় এদিন

ঢাকায় এই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা একটি টাইম বোমায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে নেজামে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রাদেশিক সরকারের মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক গুরুতর আহত হন। লালবাগে এক সভা শেষে সচিবালয়ে ফিরছিলেন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে গাড়িটি পৌঁছালে ড্রাইভারের আসনের নিচে পাতা বোমাটি বিস্ফোরিত হয়।

এদিনই জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান আমির গোলাম আজম জামায়াতের মনোনীত দুই মন্ত্রী আব্বাস আলী খান এবং এ কে এম ইউসুফের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “মুসলিম জাতীয়তাবাদকে বাদ দিয়ে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানতে রাজি নই। জামায়াতের কর্মীরা পাকিস্তান অখণ্ড রাখার সংগ্রামে নিজেদের আত্মাহুতি দিচ্ছে। এ পর্যন্ত দেশের জন্য যত শহীদ হয়েছে, তার প্রায় সবাই জামায়াতের কর্মী।”

পাকিস্তানে এদিন

করাচিতে পাকিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র একটি ঘোষণায় বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে ভারতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সামনে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার জন্য পাকিস্তানের যেসব প্রতিনিধি বিদেশ সফর করছেন, তাদের মধ্যে দৈনিক ‘ইত্তেফাক’-এর সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদ রয়েছেন।”

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের সঙ্গে দেখা করেছেন। এসময় ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

এদিনই জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের কাছে এক পত্রে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ লিখেন, “পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে। দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে, জাতিসংঘের কতিপয় সদস্য রাষ্ট্র জাতিসংঘ বিধির প্রতি সমর্থনের বুলি তোলে প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের মূলনীতিকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত হয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুলেছে।”

দেশব্যাপী এদিন

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, “জাতিসংঘের চলমান অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ২৮টি ঘটনার তথ্য পেশ করবে। ১৯৬৯ সালের মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘটনাবলীর তথ্য তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশ নামে একটি পুস্তিকা সরকার প্রকাশ করেছে।”

দেশব্যাপী প্রতিরোধযুদ্ধ

২৫ সেপ্টেম্বর গালিমপুরের যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শেষ পর্যন্ত পিছু হটে। এর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ২ নম্বর সেক্টরে ‘এমএল পয়েন্টার’ নামক একটি লঞ্চে নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে গালিমপুরের কাছে পৌঁছালে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। সারারাত ধরে চলা এই যুদ্ধে ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে হানাদাররা পালিয়ে যায়। এতে হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন জাফর আলী খান, সুবেদার আবদুল্লা সহ ৪৬ জন সৈন্য নিহত হন এবং লঞ্চটি ডুবে যায়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম এবং মুহম্মদ আলী শহীদ হন।

এদিন কুমিল্লার নারায়ণপুর গ্রামে লুটপাট শেষে ক্যাম্পে ফিরছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের একটি দল। পায়েলগাছায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল তাদের উপর আক্রমণ চালায়। হানাদাররা প্রতিরোধ গড়ে তুললে যুদ্ধ চলে, ফলে ১৩ হানাদার সৈন্য ও ১৬ রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ৫ গেরিলা শহীদ হন।

সিলেটের ছাতকের টেবলাই গ্রামে অবস্থিত এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধার উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি দল ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। কয়েকক্ষণ যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করে মেলা সাব-সেক্টরের সদর দপ্তর বাঁশতলা পর্যন্ত পিছিয়ে যান। পরে বাঁশতলা থেকে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ নিয়ে ফিরে এসে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে হানাদাররা পিছু হটে। প্রায় ৪ ঘণ্টার এই যুদ্ধে ৪ জন হানাদার সৈন্য নিহত ও বহু আহত হন। মুক্তিবাহিনীর একজন যোদ্ধা শহীদ হন।

ফরিদপুরের ভাটিয়াপাড়ায় মুক্তিবাহিনী ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনে দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালায়। এতে ১৭ জন হানাদার সৈন্য নিহত ও ৯ জন আহত হন। মুক্তিবাহিনী স্টেশনটি ধ্বংস করে দেয়। এদিনই ফরিদপুরের ভেদরগঞ্জে আরেক আক্রমণে ৮৫ জন হানাদার পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়।

ফেনীর পরশুরামের গুথুমা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ১৫ সদস্যের একটি গেরিলা দল হানাদার বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করে। এতে ৩ জন হানাদার সৈন্য হতাহত হন।

১ নম্বর সেক্টরের চম্পকনগরে মুক্তিবাহিনী রকেট লঞ্চারের সাহায্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চম্পকনগর বিওপির উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এতে বেশ কয়েকটি বাঙ্কার বিধ্বস্ত হয় এবং ৫ সৈন্য নিহত হন।

এদিন মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ফেনীর পরশুরাম ও অনন্তপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত ও আহত হন। এর আগে গত কয়েকদিন ধরে সালদা নদীর হানাদার অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও আর্টিলারি হামলা চলছিল।

সিলেটের দিয়াতলিতে হানাদার বাহিনীর সেনারা অভিযান থেকে ফিরছিল। এসময় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল তাদের উপর হামলা চালায়, ফলে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

সূত্র

- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (তৃতীয়, পঞ্চম, দশম, ত্রয়োদশ খণ্ড)

- দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

- দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০