ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

নারীর প্রতি সহিংসতা ও আমাদের সমাজের বিকৃত চিত্র

Array ( [id] => 1 [full_name] => সম্মোহন ঋক [author_url_display] => hrrik [designation] => সাংবাদিক, বিশ্লেষক [organization] => [gender] => female [dob] => 0000-00-00 [birth_place] => [email] => [contact_no] => [fb_link] => [twitter_link] => [google_link] => [pinterest_link] => [profile_desc] => [achievement] => [photo] => hrrik.jpg?v=1748521745 [address] => [division_id] => 0 [district_id] => 0 [publish] => 1 )
নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগে কারাবন্দিরা জামিনে বেরিয়েই নায়ক বনে যাচ্ছেন, তাদেরকে ফুল-মালায় বরণ করছেন একদল মানুষ | ছবি: প্রিয়ভূমি
নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগে কারাবন্দিরা জামিনে বেরিয়েই নায়ক বনে যাচ্ছেন, তাদেরকে ফুল-মালায় বরণ করছেন একদল মানুষ | ছবি: প্রিয়ভূমি

একজন নারীকে প্রকাশ্যে লাথি মারা হয়। ভিডিওটি ভাইরাল হয়। সামাজিক মাধ্যম উত্তপ্ত হয়। কিছুদিন পর সেই লাথি মারার বীর জামিনে মুক্ত হয়। তার স্বাগত জানাতে জড়ো হয় একদল মানুষ। গলায় পরানো হয় ফুলের মালা। করতালি, উল্লাস, স্লোগান—একটি অপরাধীকে নায়কে পরিণত করার পুরো প্রক্রিয়া যেন সম্পন্ন হয় সুনিপুণভাবে। এই দৃশ্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একবার নয়, বারবার ঘটেছে। প্রশ্ন হলো—একটি সমাজ যখন নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসবের মতো উদযাপন করে, তখন সেই সমাজের নৈতিক ভিত্তি কোথায় দাঁড়িয়ে?

মঞ্চে অপরাধ, দর্শক সারিতে আমরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী ইভটিজিংয়ের অভিযোগে ভাইরাল হন। গ্রেফতার হন। জামিন পান। তারপর? তাকে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। মুন্সীগঞ্জের এক ব্যক্তি লঞ্চে দুজন নারীকে "অপমানজনক অবস্থায়" দেখে প্রহার করেন। তার ভাষ্য: "আমি তাদের বড় ভাই হিসেবে শাসন করেছি।" এই "শাসনের" ভিডিও যখন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তখন একদল মানুষ তাকে "সাহসী" আখ্যা দেয়। জামিনের পর তার গলায়ও পরানো হয় ফুলের মালা।

এখানে অপরাধী কে? যে নারীকে লাথি মারা হয়েছে, যে তরুণী ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে, নাকি আমরা—যারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছি? নাকি তারা—যারা অপরাধীকে মালা পরিয়ে "বীর" বানাচ্ছে? আসলে, একটি সমাজ যখন সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়, তখন অপরাধী শুধু একজন নয়, পুরো সমাজই অপরাধের অংশীদার হয়ে যায়।

সাইবার জগত: সহিংসতার নতুন ময়দান

অফলাইনে যদি নারীদের প্রতি সহিংসতার চিত্র ভয়াবহ হয়, অনলাইন তার চেয়েও ভয়ংকর। কোনো নারী যদি রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে সোচ্চার হন, তাহলে তাকে "শায়েস্তা" করার জন্য সাইবার গ্যাং অপেক্ষায় থাকে। শ্লীলতাহানির হুমকি, বিকৃত মিমস, যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য—এগুলো এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

কিন্তু কেন? কারণ, অনলাইন সহিংসতাকে আমরা "নর্মালাইজ" করে ফেলেছি। একটি জঘন্য মন্তব্যের নিচে শতাধিক লাইক পড়ে, কেউ প্রতিবাদ করে না। বরং হাসি-তামাশা চলে। এই নীরবতা আসলে সম্মতিরই নামান্তর।

গায়ের রঙ, মব জাস্টিস ও সমাজের দ্বিচারিতা

মজার ব্যাপার হলো, এই সহিংসতায়ও "রঙের ভেদাভেদ" কাজ করে। একজন গৌরবর্ণ নারী যদি কোনো রাজনৈতিক মত প্রকাশ করেন, তাহলে তাকে "বিয়ে করে ফিক্স" করার কথা শোনা যায়। আর একজন কালো নারী একই কাজ করলে তাকে "ময়লা" আখ্যা দিয়ে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়।

এখানে নারীর মতামত গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ তার চেহারা। এই মনোভাব প্রমাণ করে যে, আমাদের সমাজে নারী এখনও "বস্তু" হিসেবেই গণ্য হয়। তার মতামত, তার স্বাধীনতা—এসবের কোনো মূল্য নেই।

মব সাইকোলজি: ভিড়ের অন্ধত্ব

গুস্তাভ ল্যাবনের মতে, ভিড়ের মধ্যে মানুষের ব্যক্তিগত বিবেক লোপ পায়। একজন মানুষ যখন একা থাকে, সে হয়তো কখনোই কাউকে পিটিয়ে মারত না। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সে হিংস্র হয়ে ওঠে। কারণ, ভিড় তাকে দায়মুক্তির অনুভূতি দেয়

কিন্তু এই দায়মুক্তির মূল্য কে দেয়? যে নারীটি লাঞ্ছিত হয়। যে তরুণীটি অপমান সহ্য করে। যে মেয়েটি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।

শিক্ষা: ডিগ্রি নাকি বিবেক?

আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে, কিন্তু নৈতিকতা বাড়ছে কি? একজন ইঞ্জিনিয়ার যদি নারীদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তাহলে তার ডিগ্রির মূল্য কতটুকু? একজন ডাক্তার যদি মনে করে যে নারীকে "শাসন" করা যায়, তাহলে তার জ্ঞানের পরিধি কতটা মানবিক?

শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একটি সুস্থ, সংবেদনশীল ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠন। কিন্তু আমরা কি তা করছি?

সমাধান: গোড়া থেকে পরিবর্তন

নৈতিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া: স্কুল-কলেজে নারী-পুরুষের সমতা, মানবাধিকার ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

আইনের কঠোর প্রয়োগ: নারীদের প্রতি সহিংসতায় জড়িতদের দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

সামাজিক আন্দোলন: নারীদের পাশে দাঁড়াতে পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে। নীরবতা ভাঙতে হবে।

মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমের দায়িত্ব: সহিংসতাকে "ভাইরাল" করার বদলে এর নিন্দা করতে হবে।

শেষ কথা: আমরা কোন দিকে যাচ্ছি?

একটি সমাজ তখনই ধ্বংস হয়, যখন তার নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। নারীদের প্রতি সহিংসতা কেবল নারীর সমস্যা নয়, এটি পুরো সমাজের সমস্যা। যে সমাজ নারীকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই সমাজ কখনোই উন্নত হতে পারে না।

আমরা যদি সত্যিই একটি সুন্দর বাংলাদেশ চাই, তাহলে নারীর প্রতি এই সহিংসতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। কারণ, একটি দেশের অগ্রগতি তখনই সম্ভব, যখন তার নারীরা নিরাপদ ও স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাথরাইল-নলশোদা গণহত্যা (দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল)

৩০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর সফল গেরিলা অভিযান

গঙ্গাচড়ার সহিংসতা / রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব ও সমাজের নীরবতা

২৯ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ কার্যক্রম তীব্রতর

সংবিধানের সঙ

২৭ জুলাই ১৯৭১: বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সাহসী আক্রমণ

২৬ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

রাধুটিলা গণহত্যা (বিয়ানীবাজার, সিলেট)

২৪ জুলাই ১৯৭১: ভেনিজুয়েলা ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ

পাতারচর গণহত্যা (মুলাদী, বরিশাল)

১০

মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়

১১

২৩ জুলাই ১৯৭১: বিশ্ব শক্তি বাংলাদেশ সংকট নিয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত

১২

২২ জুলাই ১৯৭১: টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ

১৩

ভাড়ায় চাপাতি ও মোটরসাইকেল: রাজধানীর অপরাধ জগতের ভয়াবহ নতুন রূপ

১৪

রাজনীতির উনমানুষরাই প্রলাপ ডাকে বেশি

১৫

২১ জুলাই ১৯৭১: ঠাকুরগাঁওয়ে গেরিলা অভিযান মুক্তিযোদ্ধাদের

১৬

মবতন্ত্রের জয়

১৭

ডিজিটাল দাসত্ব: মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

১৮

২০ জুলাই, ১৯৭১: বাংলাদেশে কুচক্রী আগ্রাসন

১৯

২০ জুলাই ১৯৭১: বিলমাড়িয়া হাটে গণহত্যা পাকিস্তানি সেনাদের

২০