বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর (সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী) যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামাদির সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করা যাক। বাংলাদেশের সামরিক শক্তি মূলত চীন ও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক একটি নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ) এই নির্ভরতাকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করেছে, যা দেশের অর্থনীতি ও সামরিক সক্ষমতার উপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নিম্নে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সরঞ্জামাদি এবং এই চুক্তির সম্ভাব্য পরিণতির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম
ট্যাঙ্ক: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে ৩২০টি ট্যাঙ্ক রয়েছে, যার মধ্যে ২৮১টি চীনের তৈরি। ২০১৪ সাল থেকে চীন থেকে কিট এনে এই ট্যাঙ্কগুলো আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।
মাল্টিপল রকেট লঞ্চার সিস্টেম: ৭৭টি রকেট লঞ্চার রয়েছে, যার মধ্যে ৪৯টি চীনের এবং ২৮টি তুরস্কের তৈরি।
আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি): বেশিরভাগ এপিসি রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) তৈরি, কিছু যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের তৈরি।
কামান: মোট ৪৬৪টি কামান রয়েছে, যার মধ্যে ২৭টি স্বয়ংক্রিয় এন্টি-এয়ারক্রাফট কামান। এগুলোর সিংহভাগ চীনের তৈরি।
স্মল আর্মস ও গোলাবারুদ: সমরাস্ত্র কারখানায় স্মল আর্মস ও রাইফেল তৈরি হয়। ১৯৭৭ সালে চীনের কারিগরি সহায়তায় এই কারখানার উৎপাদন শুরু হয়। গোলাবারুদ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে শতভাগ কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ চীন থেকে আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সরঞ্জাম
সাবমেরিন: দুটি সাবমেরিন রয়েছে, উভয়ই চীনের তৈরি এবং পূর্বে চীনের নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত।
নৌযান: মোট ১১৭টি নৌযান রয়েছে, যার মধ্যে:
ফ্রিগেট: ৭টি, যার ৪টি চীন, ২টি যুক্তরাষ্ট্র এবং ১টি কোরিয়ার তৈরি।
কর্ভেট: ৬টি, যার ৪টি চীন এবং ২টি যুক্তরাজ্যের তৈরি।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বহর
যুদ্ধ বিমান: মোট ২১২টি বিমানের মধ্যে ৪৪টি যুদ্ধ বিমান। এর মধ্যে ৩৬টি চীনের তৈরি এফ-৭ সিরিজ এবং ৮টি রাশিয়ার মিগ-২৯ সিরিজের।
প্রশিক্ষণ বিমান: রাশিয়ার ১৪টি ইয়াক-১৩০ বিমান প্রশিক্ষণ ও হালকা আক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
হেলিকপ্টার: ৭৩টি হেলিকপ্টার, যার মধ্যে ৩৬টি রাশিয়ার এমআই সিরিজ, ২৪টি যুক্তরাষ্ট্রের সেসনা ও বেল মডেল, এবং চীনের এফটি-৭ প্রশিক্ষণ বিমান।
পরিবহন বিমান: যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড সিরিজের ২টি কৌশলগত পরিবহন বিমান।
চীন ও রাশিয়ার উপর নির্ভরতা
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী তার যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামের জন্য মূলত চীন ও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভরতা চীনের উপর। এর কারণ হলো তুলনামূলক কম দাম, রক্ষণাবেক্ষণের সহজলভ্যতা এবং খুচরা যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতা। বিমানবাহিনীও চীন ও রাশিয়ার সরঞ্জামের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের প্রভাব
সাম্প্রতিক রিসিপ্রোকাল ট্যাক্স ৩৫% থেকে ২০%-এ নামিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সেনাসদরে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে এই বার্তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, চীন ও রাশিয়া থেকে সরঞ্জাম ক্রয় অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
সামরিক সক্ষমতার উপর প্রভাব
চীন ও রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া: বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা চীন ও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। এই দুই দেশ যদি রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত বা খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের ট্যাঙ্ক, কামান, সাবমেরিন, নৌযান এবং যুদ্ধ বিমানের বেশিরভাগ অকেজো হয়ে পড়বে। এটি দেশের সামরিক শক্তিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা: এনডিএর মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা দেশের স্বাধীন সামরিক নীতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি: বাংলাদেশের উৎপাদন খাতের কাঁচামালের সিংহভাগ চীন থেকে আসে। এনডিএর ফলে চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। চীন যদি রপ্তানির উপর কঠোর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে।
প্যাকেজ ডিলের ক্ষতি: রিসিপ্রোকাল ট্যাক্স কমানোর জন্য বাংলাদেশকে ২৫টি বোয়িং বিমান ক্রয়, উচ্চমূল্যে গম ও অন্যান্য পণ্য ক্রয়ের প্যাকেজ ডিলে সম্মত হতে হয়েছে। এটি অর্থনীতির উপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বিরোধীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছেন। তবে তিনি সকল পরাশক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়েছিলেন। বিপরীতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এনডিএ স্বাক্ষর দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে বিপন্ন করেছে। এই চুক্তি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের গোলামীতে পরিণত করেছে এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে দেশকে একটি অর্থনৈতিক ও সামরিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট বাংলাদেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। চীন ও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল সামরিক সক্ষমতা এই চুক্তির ফলে পঙ্গু হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। একই সঙ্গে, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষতি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করবে। এই চুক্তি বাংলাদেশকে একটি “ডেথ স্পাইরালে” ঠেলে দিয়েছে, যা থেকে স্বল্পমেয়াদে মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশের জনগণের এই সংকট সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি।
মন্তব্য করুন