১০ আগস্ট ২০২৫, একটি খবর বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ঢাকা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুলাউড়ায় একজন স্কুলছাত্রকে ফেসবুকে ভিডিওর মাধ্যমে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া এবং শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন জানানোর কারণে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি স্কুলছাত্রের গ্রেপ্তারের বিষয় নয়, বরং এটি শিশু অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। এই প্রতিবেদনে ঘটনাটির বিশদ বিবরণ, এর প্রভাব এবং এর পেছনের নৈতিক ও আইনি দিকগুলো বিশ্লেষণ করা হবে।
ঘটনার বিবরণ
ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুসারে, একটি ৪৭ সেকেন্ডের ভিডিওতে ওই স্কুলছাত্রকে একটি কক্ষে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। তার সামনে একটি টেবিল এবং পেছনে বিএনপি নেতা প্রয়াত এম সাইফুর রহমানের ছবিসংবলিত একটি ব্যানার টানানো ছিল। ভিডিওতে ছাত্রটি বলে, “একমাত্র শেখ হাসিনা ছিলেন বাংলাদেশের একজন গর্বিত নারী। ইনশাআল্লাহ তিনি একদিন না একদিন ফিরে আসবেন। ইনশাআল্লাহ আওয়ামী লীগ আবার ফিরে আসবে। জয় বাংলা, জয় বাংলা। আমি শেখ হাসিনার লোক। গর্ব করে বলতে পারি আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। ইনশাআল্লাহ আবার দেখা হবে রাজপথে, ধন্যবাদ।”
এই ভিডিওটি প্রথমে “কুলাউড়া ডটকম” নামে একটি ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয় এবং পরে “স্বাধীন ২৪/৭” নামে আরেকটি পেজে শেয়ার হওয়ার পর ভাইরাল হয়। কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ওমর ফারুক গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ভিডিওটি নজরে আসার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে ছাত্রটিকে গ্রেপ্তার করে।
শিশু অধিকার সনদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের দ্বাদশ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “মতামত গঠনে পরিপক্ক শিশু নিজস্ব মতামত এবং ধারণা প্রকাশে অবাধ স্বাধীনতার অধিকারী।” এই সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এই অধিকার রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। সনদ অনুযায়ী, শিশুর বয়স এবং প্রকাশ ক্ষমতা বিবেচনায় তার মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু একজন ষোল বছর বয়সী স্কুলছাত্রকে তার রাজনৈতিক মত প্রকাশের জন্য গ্রেপ্তার করা কতটা ন্যায্য?
এই ঘটনা শিশু অধিকার সনদের সরাসরি লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হতে পারে। একজন কিশোরের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের জন্য তাকে ‘অভিযান চালিয়ে’ গ্রেপ্তার করা শুধুমাত্র তার অধিকার হরণই নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি প্রশ্ন তুলেছে।
ফ্যাসিজমের ছায়া?
এই ঘটনাকে অনেকে ফ্যাসিস্ট আচরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাজনীতি বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ফ্যাসিজমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ভিন্নমত দমন করা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কণ্ঠরোধ করা। একটি স্কুলছাত্রের ভিডিও, যা অন্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে, তার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা এই ধরনের আচরণেরই প্রতিফলন। এটি শুধুমাত্র শিশু অধিকারের লঙ্ঘন নয়, বরং গণতান্ত্রিক সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপরও আঘাত।
এই ঘটনা প্রশ্ন তুলেছে যে, একটি কিশোরের মতামত কি এতটাই হুমকিস্বরূপ যে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে? তার বক্তব্য কারও পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু সেটি কি আইনি শাস্তির যোগ্য? গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমতকে সহ্য করার ক্ষমতা থাকা উচিত, বিশেষ করে যখন এটি একজন কিশোরের কাছ থেকে আসছে, যার রাজনৈতিক মতামত গঠনের প্রক্রিয়া এখনও পরিপক্ক হয়নি।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
এই গ্রেপ্তারের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে এটিকে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নমুনা হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে, শিশু অধিকারের প্রশ্নটি সামনে এসেছে, যা সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই ঘটনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতাকেও তুলে ধরেছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে, শিশু এবং কিশোরদের মতপ্রকাশের অধিকারকে উৎসাহিত করা উচিত, শাস্তি দেওয়া নয়। এই ধরনের ঘটনা সমাজে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, যা তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করবে।
আইনি ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কার করার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু এই গ্রেপ্তার ঘটনা প্রমাণ করে যে এই দায়িত্ব পালনে ঘাটতি রয়েছে। একজন কিশোরের বিরুদ্ধে ‘অভিযান চালিয়ে’ গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত কেবল আইনের অপপ্রয়োগই নয়, বরং এটি নৈতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশের ভূমিকা হওয়া উচিত জনগণের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করা, নয়তো তাদের কণ্ঠরোধ করা। এই ঘটনায় পুলিশের পদক্ষেপকে অনেকে অতিরিক্ত এবং অযৌক্তিক বলে মনে করছেন। এটি প্রশ্ন তুলেছে যে, রাষ্ট্র কি শিশুদের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, নাকি এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে?
একজন স্কুলছাত্রের গ্রেপ্তারের ঘটনা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, শিশু অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। একটি কিশোরের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা শুধুমাত্র জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের লঙ্ঘন নয়, বরং এটি গণতান্ত্রিক সমাজের মূলনীতির বিরুদ্ধে যায়।
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের উচিত শিশু অধিকার রক্ষায় আরও সচেতন হওয়া এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করা। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমতকে শুধু সহ্যই করা উচিত নয়, বরং এটিকে উৎসাহিত করা উচিত। এই ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি। তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠকে দমিয়ে নয়, বরং তাদের মতামতের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা উচিত।
মন্তব্য করুন