ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
শহীদ বুদ্ধিজীবী

খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদ

প্রিয়ভূমি ডেস্ক
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৫, ০৪:৩০ পিএম
খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদ
খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদ

তখন শ্রাবণ মাস। সেদিন সকালে বৃষ্টি হয়েছিল। দুপুরে ঝলমলে রোদ। কাদা মাড়িয়ে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা মেহেরপুরের মুজিবনগরের সীমান্তবর্তী জয়পুর গ্রামের গোপন শিবিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।

এ সময় খবর আসে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা গ্রামে ঢুকছে। মুক্তিযোদ্ধারা বর্বরদের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিলেন। দুই ভাগে ভাগ হয়ে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ হন ক্রীড়াবিদ, সংস্কৃতিসেবী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদসহ আটজন মুক্তিযোদ্ধা।

ঐতিহাসিক এই প্রতিরোধযুদ্ধ হয়েছিল একাত্তরের ৫ আগস্ট মেহেরপুরের বাগোয়ান গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরিণাম কী হবে, তা বোঝাতে হানাদার সেনারা শহীদদের লাশগুলো নিয়ে ঘুরে ঘুরে গ্রামের লোকদের দেখায়। এরপর চুয়াডাঙ্গা জেলার জগন্নাথপুর গ্রামে দুটি গর্ত করে আট শহীদকে গণকবর দেয়।

বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ ভূমিখ্যাত মুজিবনগরের নিকটবর্তী বাগোয়ান গ্রামের পাশে জয়পুরে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন শিবির। গেরিলাযুদ্ধ চালানোর জন্য ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই শিবিরে সমবেত হয়েছিলেন ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা।

এর অদূরে নাটুদহ হাজার দুয়ারি স্কুলে ছিল পাকিস্তানি সেনাক্যাম্প। ছদ্মবেশী রাজাকার কুবাদ খাঁ মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে এসে মিথ্যা খবর দেয়, হানাদার সেনাদের সহায়তায় রাজাকাররা বাগোয়ান মাঠের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

এই মিথ্যা খবরে মুক্তিযোদ্ধারা দুই ভাগ হয়ে হানাদার সেনাদের প্রতিরোধ করতে যান। কয়েক ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষে তুমুল সম্মুখযুদ্ধ চলে। যুদ্ধে একটি দলের নেতা খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদসহ আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

শহীদ খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদের জন্ম ১৯৪৬ সালে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কাটদহ গ্রামে। বাবা মহিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মা রোমেলা বেগম গৃহিণী। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। শৈশব থেকেই খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় যুক্ত ছিলেন। তাঁর পরিবারের সবাই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণ নেন।

তাঁর নেতৃত্বে বিশাল গণবাহিনী গড়ে ওঠে। যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর এলাকায়। বৃহত্তর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ ও সম্মুখযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। শহীদ খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদের আত্মত্যাগের কাহিনি মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের আজও অনুপ্রাণিত করে।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর, আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রফিকুর রশীদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা, অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তোজাম্মেল আযমের মুজিবনগর: যুদ্ধজয়ের উপাখ্যান বইয়ে তাঁকে একাত্তরের প্রতিরোধযুদ্ধের সাহসী যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এ ছাড়া জাহিদ রহমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮ এবং রাজীব আহমেদের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ: চুয়াডাঙ্গা জেলা বইয়ে শহীদ খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদের বীরোচিত আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ খালেদ সাইফুদ্দীনের বাবাকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি পাঠান। শহীদ খালেদ সাইফুদ্দীন ও একাত্তরের ৫ আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে চুয়াডাঙ্গার জগন্নাথপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তমঞ্চ ও মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালা নির্মাণ করা হয়েছে।

এটি আট কবর স্মৃতি কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। প্রতিবছর চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জগন্নাথপুর গ্রামে ৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

শহীদ খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদ ছিলেন অবিবাহিত। তাঁর ছোট বোন খালেদা নিলুফার বানু বলেন, তাঁদের একমাত্র ভাই দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দান করেছেন, এ জন্য তাঁরা গর্ববোধ করেন।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশের সামরিক নির্ভরতা ও নন-ডিসক্লোজার চুক্তির সংকট

২ আগস্ট ১৯৭১: দেশজুড়ে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধ

৩১ জুলাই ১৯৭১: কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটিতে তীব্র যুদ্ধ

পাথরাইল-নলশোদা গণহত্যা (দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল)

৩০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর সফল গেরিলা অভিযান

গঙ্গাচড়ার সহিংসতা / রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব ও সমাজের নীরবতা

২৯ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ কার্যক্রম তীব্রতর

সংবিধানের সঙ

২৭ জুলাই ১৯৭১: বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সাহসী আক্রমণ

২৬ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

১০

রাধুটিলা গণহত্যা (বিয়ানীবাজার, সিলেট)

১১

২৪ জুলাই ১৯৭১: ভেনিজুয়েলা ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ

১২

পাতারচর গণহত্যা (মুলাদী, বরিশাল)

১৩

মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়

১৪

২৩ জুলাই ১৯৭১: বিশ্ব শক্তি বাংলাদেশ সংকট নিয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত

১৫

২২ জুলাই ১৯৭১: টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ

১৬

ভাড়ায় চাপাতি ও মোটরসাইকেল: রাজধানীর অপরাধ জগতের ভয়াবহ নতুন রূপ

১৭

রাজনীতির উনমানুষরাই প্রলাপ ডাকে বেশি

১৮

২১ জুলাই ১৯৭১: ঠাকুরগাঁওয়ে গেরিলা অভিযান মুক্তিযোদ্ধাদের

১৯

মবতন্ত্রের জয়

২০