ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

দুই প্রধানের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই: কে জিতল, কে হারল?

মনজুরুল হক
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫, ০২:১১ পিএম
দুই প্রধানের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই: কে জিতল, কে হারল?

বাংলাদেশে মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের দূতিয়ালি, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও অপ্রকাশিত বিশেষ ব্যক্তিদের ‘কুল থ্রেট’-এর ফলাফল - দুই পক্ষের উইন-উইন সিচুয়েশনে অবশেষে তর্জন-গর্জনের পরিসমাপ্তি হলো। ইন্টেরিম চীফ মুহাম্মদ ইউনূস বনাম সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান - দুই পক্ষেরই জয় হলো কিংবা কেউ পরাজিত হলো না।

জেনারেল ওয়াকার ২১ তারিখে দীর্ঘ ভাষণে এবং প্রশ্নোত্তরে যে সকল সিদ্ধান্ত নিলেন, যে সকল সতর্কবাণী দিলেন, যে সকল কৃতকর্তব্য ঘোষণা করলেন - তার মধ্যে তেমন কোনো নতুনত্ব নেই। করিডোর বাদে বাকি বিষয়গুলো তিনি গত ফেব্রুয়ারিতে রাওয়া ক্লাবের ভাষণেও বলেছিলেন। আজকের ‘দরবারে’ যা বলেছেন তার বিশদ আলোচনার কিছু নেই। চুম্বক অংশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে তিনি সতর্ক করে বলেছেন:

১. [মানবিক করিডরের মতো স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই। শুধুমাত্র একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ পূর্বক এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। করিডোর বিষয়ে সরকার কী ভাবছেন অথবা জাতিকে একটি প্রক্সি ওয়ারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিনা, এই বিষয়ে সরকার স্পষ্টভাবে কিছুই জানাচ্ছে না। অনুষ্ঠানের পরের অংশে এক অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘There will be no corridor’]

২. [জাতিসংঘ কর্তৃক জুলাই-আগস্ট বিষয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে তাতে সেনাবাহিনীর কোনো বক্তব্য নেয়া হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানতে পারেন যে, জাতিসংঘ সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও বর্তমান সরকার জাতিসংঘকে সে সুযোগ দেয়নি]

৩. [সংস্কার সহ বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা কিভাবে নিচ্ছে সে বিষয়ে দেশবাসীর পাশাপাশি তিনি এবং সেনাবাহিনী অবগত নন বলে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। পরবর্তীতে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি উল্লেখ করেন যে, প্রথম দিন থেকেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে তিনি বারংবার সরকারকে অনুরোধ করেছেন। তবে সরকার অনুরূপ সংস্কারের বিষয়ে সত্যিকার অর্থে সিরিয়াস নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন]

৪. [গত ২০ মে ২০২৫ তারিখ রাতে অনুষ্ঠিত সভায় এর পূর্ব রাতে সেনা ভবনে কোনো গোপন সভা হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে তিনি সরকার কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হন বলে সেনাপ্রধান উল্লেখ করেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি বলেন যে, সেনাপ্রধান যে কোনো সময়ে অর্পিত দায়িত্বের খাতিরে সভা আয়োজন করতে পারেন এবং এছাড়া সেনাপ্রধানকে যে সাংবিধানিক অধিকার দেয়া আছে তাতে করে তার কোনো ষড়যন্ত্রমূলক সভা করার প্রয়োজনীয়তা নেই]

৫. [চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার এই সরকারের নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। একের পর এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে এই বিষয়েও সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই]

৬. [সহযোদ্ধা প্ল্যাটফর্মের বিষয়ে উল্লেখ করে একজন অফিসার সেনাবাহিনী হতে বরখাস্ত সেনা সদস্যদের অপরাধসমূহ আইএসপিআরের মাধ্যমে জাতিকে জানানোর প্রস্তাব করেন। এর উত্তরে তিনি বলেন- 'মহান আল্লাহ অন্যদের দোষ গোপন রাখার নির্দেশনা প্রদান করেছেন বলে এখনো পর্যন্ত এরূপ পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, তবে এ বিষয়টি সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে']

৭. [সেনাবাহিনী আর সড়কে সৃষ্ট নৈরাজ্য সহ্য করবে না। বিক্ষোভের নামে সহিংসতা বরদাস্ত করা হবে না]

সর্বশেষ এই বক্তব্যটি আরও একটি নিরেট সত্য তুলে ধরে, তা হলো কথিত বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, দাবি আদায়, মব ভায়োলেন্স, মব জাস্টিস, মব লিঞ্চিং, প্রতিপক্ষের লোকজনের উপর আক্রমণ, তাদের বিচার এবং রায় ঘোষণা করে তা বাস্তবায়ন করার মতো জঘন্য ঘটনাগুলো সেই ৫ আগস্ট '২৪ থেকেই হচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু স্তিমিত হয়ে আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে রাজপথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে!

সেনাপ্রধানের 'বরদাস্ত করা হবে না' হুমকিটি কেন ৯ মাস আগেই আসল না? গত ৯ মাস ধরেই তো এসব চলছে। দেশে এখন চূড়ান্ত নৈরাজ্য চলছে। তাঁর বাহিনী ওইসব বেআইনি মবকে ফুলের টোকাটিও দেয়নি। চরম অপমানজনক গালাগালি শুনেও নীরবে মৃদু হেসে তাদের আদর করে বুঝিয়েছেন।

দিনের পর দিন মাত্র কয়েকজন মানুষ একটা মোবাইলে বিগত সরকার প্রধানের সঙ্গে ছবি আছে এই 'অপরাধে' ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে হুমকি দিচ্ছে, সেনাবাহিনীকে হুমকি দিচ্ছে, সরকারের বিন্দু পরিমাণ সমালোচনা করলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি চলে যাচ্ছে, পত্রিকা অফিস ঘেরাও হচ্ছে, সাংবাদিকদের নামে হত্যা মামলা হচ্ছে, জেলে ভরা হচ্ছে, শিক্ষকদের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে অপমান অপদস্থ করা হচ্ছে, বিগত সরকারের সঙ্গে সংস্রব আছে বলে একটার পর একটা কারখানা জ্বালিয়ে শত শত শ্রমিক হত্যা করা হচ্ছে, প্রায় ২ লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে, নারী সমাজ নিয়ে মোল্লারা বেআইনি ফতোয়া দিয়ে কুৎসিত গালি দিচ্ছে, দেশের সকল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-সৌধ-ম্যুরাল-ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে... আর তখন দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া সেনাপ্রধান বলছেন-'আর বরদাস্ত করা হবে না'!

দেশের অর্থনীতি, কল-কারখানা, উৎপাদন, রপ্তানি বাণিজ্য শেষ। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পেরে কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে। সরকার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, সেনাবাহিনী কারও সঙ্গে মতবিনিময় না করেই দেশের ভূখণ্ড দিয়ে দিচ্ছেন পরাশক্তিকে। তাদের মেরিন সেনারা কক্সবাজার অঞ্চলে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভারতের 'সেভেন সিস্টার্স' নিয়ে বাগাড়ম্বর, রাখাইনের করিডোর দেওয়া, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের দিয়ে দেওয়াসহ একটা দেশ ব্যর্থ হতে যা যা করতে হয় সবই করা হচ্ছে নির্বিকার ও চরম ঔদ্ধত্যে।

এই ক্রান্তিকালে সেনাপ্রধানের সাবধান করে দেওয়া ভাষণের নিট রেজাল্ট- মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের দূতিয়ালি, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও অপ্রকাশিত বিশেষ ব্যক্তিদের 'কুল থ্রেট'-এ ড. ইউনূস আরও ৭ মাস সময় 'পারচেজ' করে নিলেন।

ডিসেম্বরে আদৌ নির্বাচন হবে কিনা, সেই নির্বাচন 'ইনক্লুসিভ' হবে কিনা, ড. ইউনূস এবং তার আমন্ত্র্যবর্গ সুবিধাভোগীরা ক্ষমতা ছাড়বেন কিনা, দেশে সংস্কারের বন্যা বয়ে যাবে কিনা, সেই বন্যায় বিদেশি পাসপোর্টধারীরা ছিপ ফেলে মাছ শিকার করবে কিনা... এইসব বক্তব্য আর কোনো আশার দিকনির্দেশ করে না, কারণ মার্কিনের স্বার্থের বিরুদ্ধাচারণের ক্ষমতা এই দেশের দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তাদের নেই। আর জনগণ? জনগণের এখন একটিই চাওয়া-'ভিক্ষা চাই না, কুকুর ঠেকাও'।

মনজুরুল হক-এর ফেসবুক থেকে

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৩১ জুলাই ১৯৭১: কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটিতে তীব্র যুদ্ধ

পাথরাইল-নলশোদা গণহত্যা (দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল)

৩০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর সফল গেরিলা অভিযান

গঙ্গাচড়ার সহিংসতা / রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব ও সমাজের নীরবতা

২৯ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ কার্যক্রম তীব্রতর

সংবিধানের সঙ

২৭ জুলাই ১৯৭১: বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সাহসী আক্রমণ

২৬ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

রাধুটিলা গণহত্যা (বিয়ানীবাজার, সিলেট)

২৪ জুলাই ১৯৭১: ভেনিজুয়েলা ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ

১০

পাতারচর গণহত্যা (মুলাদী, বরিশাল)

১১

মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়

১২

২৩ জুলাই ১৯৭১: বিশ্ব শক্তি বাংলাদেশ সংকট নিয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত

১৩

২২ জুলাই ১৯৭১: টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ

১৪

ভাড়ায় চাপাতি ও মোটরসাইকেল: রাজধানীর অপরাধ জগতের ভয়াবহ নতুন রূপ

১৫

রাজনীতির উনমানুষরাই প্রলাপ ডাকে বেশি

১৬

২১ জুলাই ১৯৭১: ঠাকুরগাঁওয়ে গেরিলা অভিযান মুক্তিযোদ্ধাদের

১৭

মবতন্ত্রের জয়

১৮

ডিজিটাল দাসত্ব: মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

১৯

২০ জুলাই, ১৯৭১: বাংলাদেশে কুচক্রী আগ্রাসন

২০