১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়। এই প্রতিবেদনে সেদিনের ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দুটি উৎস থেকে সংগ্রহ করে একটি সমন্বিত এবং বিশদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলো।
সামরিক সংঘর্ষ
বিরামপুর, সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জের বিরামপুরে মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ চালায়, যার ফলে ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং অনেকে আহত হয়। দুঃখজনকভাবে, এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা এবং ত্যাগের মাত্রা প্রকাশ করে।
নালিতাবাড়ী, শেরপুর
শেরপুরের নালিতাবাড়ী থানার তন্তর ও মায়াঘাসি এলাকায় ল্যান্সনায়েক মেজবাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি মুক্তিবাহিনী দল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি টহলদলের উপর আক্রমণ চালায়। এই মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। তবে এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্সনায়েক মেজবাহ উদ্দিন গুরুতর আহত হন, যা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও ত্যাগের আরেকটি উদাহরণ।
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হিয়াকু ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগতভাবে পিছু হটে নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। এই ঘটনা মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত দক্ষতা এবং সাহসিকতার প্রমাণ বহন করে।
সিলেট
ছোটলেখা চা-বাগান
সিলেটের ছোটলেখা চা-বাগানে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে দুই ঘণ্টা ধরে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এই সংঘর্ষে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য গুরুতর আহত হয়, এবং মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেনও গুরুতর আহত হন।
মনুনদী
সিলেটের মনুনদীতে মুক্তিবাহিনীর একটি অবস্থানের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুললে উভয় পক্ষের মধ্যে ৪ ঘণ্টা ধরে তীব্র যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ২০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। দুঃখজনকভাবে, এই সংঘর্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোহবান বাবুল শহীদ হন।
কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়ার ইউনাইটেড স্কুলে মুজাহিদদের প্রথম দল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। কুষ্টিয়া জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমদ এবং আহমদ আলী মুজাহিদদের বাংলা ও উর্দুতে শপথবাক্য পাঠ করান। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে নতুন যোদ্ধাদের সম্পৃক্ততা এবং সংগঠিত প্রতিরোধের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশ ইস্যু
মার্কিন সিনেটর প্রক্সমায়ার এবং সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির অবসান হওয়া উচিত। তারা গণহত্যা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর উপর চালানো বর্বরতার তীব্র নিন্দা করেন। তারা জানান, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়কে উপেক্ষা করেছে এবং লাখ লাখ মানুষকে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছে। এই শরণার্থীদের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক নাগরিকদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে, এবং সাধারণ মানুষ চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তারা আরও উল্লেখ করেন, মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য হাজার হাজার তরুণ গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করছে। পাকিস্তান সরকার যদি রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ না নেয়, তবে কেবল পাকিস্তান নয়, গোটা অঞ্চলের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
জাতিসংঘে উ থান্টের নিষ্ক্রিয়তা
দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক ডাকার পরিকল্পনা করছেন। এ লক্ষ্যে তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর মতামত জানতে চিঠি পাঠিয়েছেন। ভারত সরকার এই প্রস্তাব নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করে এবং উ থান্টের প্রস্তাবে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চার মাসের বিভীষিকা নিয়ে কোনো উল্লেখ না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করে। ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতিবিষয়ক কমিটি কেবলমাত্র কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক ডাকার বিরোধিতা করে, কারণ তারা মনে করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সামরিক শাসনের মধ্যকার দ্বন্দ্বই মূল বিষয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট ফোরাম আয়োজিত এক সমাবেশে বলেন, পাকিস্তানের অভিযোগ যে ভারত বাংলাদেশি শরণার্থীদের দেশে ফিরতে বাধা দিচ্ছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, ভারত সরকার বারবার বলেছে যে শরণার্থীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ দেশে ফিরে যাওয়াই তাদের কামনা। এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারতবিরোধী নীতির প্রতিবাদ জানায়।
যুক্তরাজ্যে শেখ মুজিবের বিচার নিয়ে উদ্বেগ
লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থকরা জানান, বিশিষ্ট আইনবিদ শন ম্যাক্সব্রাইড পাকিস্তানে যাচ্ছেন। তাঁর উদ্দেশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার এবং তাঁর সম্ভাব্য প্রাণদণ্ড রোধ করা। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেবে কি না, তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন ছিলেন।
চীনের অবস্থান নিয়ে সমালোচনা
সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশের প্রতি চীনের মনোভাব বিপর্যয়কর এবং বেদনাদায়ক। তিনি উল্লেখ করেন, অতীতে চীন বিশ্বের বিভিন্ন জনগণের সংগ্রামকে সমর্থন করলেও বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা অত্যাচারীর পক্ষ নিয়েছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আগ্রাসন
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী এই দিন ভারতের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সোনামুড়া নামে একটি সীমান্তবর্তী গ্রামে গোলাবর্ষণ করে। এতে তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হন। এছাড়াও, আসামের লাতু গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মর্টার গোলাবর্ষণ করে, যার ফলে তিনজন নারীসহ আটজন আহত হন এবং বেশ কিছু বাড়িঘর ধ্বংস হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
২৭ জুলাই ১৯৭১-এর ঘটনাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা এবং জটিলতার প্রতিফলন ঘটায়। মুক্তিবাহিনীর সাহসী আক্রমণ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিরোধ যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরে। একই সঙ্গে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া এবং জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশের পরিস্থিতির জটিলতাকে আরও স্পষ্ট করে। শরণার্থী সংকট, গণহত্যা এবং নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম আন্তর্জাতিক মঞ্চে উত্থাপিত হলেও কার্যকর সমাধানের অভাব ছিল স্পষ্ট।
২৭ জুলাই ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মুক্তিবাহিনীর সাহসী প্রতিরোধ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়া এই দিনের ঘটনাগুলোকে ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ এবং সংগ্রাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, চার, পাঁচ ও এগারো।
ইত্তেফাক, ২৮ ও ২৯ জুলাই ১৯৭১।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২৮ ও ২৯ জুলাই ১৯৭১।
মন্তব্য করুন