২ আগস্ট ১৯৭১-এ মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই দিনে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অভিযান পরিচালিত হয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও দৃঢ়তার প্রমাণ বহন করে।
এই দিন রাজশাহীতে জিন্নাত ইসলামিক ইনস্টিটিউট হলে মিয়া মোহাম্মদ কাসেমীর সভাপতিত্বে রাজাকার বাহিনীর প্রথম ব্যাচের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে রাজাকারদের পবিত্র কোরআন শরীফ স্পর্শ করিয়ে শপথ করানো হয়। এই ঘটনা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সংগঠিত প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
২ আগস্ট ১৯৭১-এ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থী সংকট নিয়ে ব্যাপক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী এই সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী টাইম এই দিন একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘Pakistan’s Agony’ (পাকিস্তানের যন্ত্রণা)। প্রচ্ছদে একজন অসহায় বাবার ছবি ছাপা হয়, যিনি রুগ্ন শিশু কোলে ভারতে আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছেন। প্রতিবেদনে টাইম-এর সংবাদদাতা লেখেন:
“পথ-প্রান্তর, নদী-নালা, খাল-বিল, বন-বাদাড় পেরিয়ে পিপীলিকার মতো হাজারো উদ্বাস্তু বাঙালি ভারতে ঢুকছে। গায়ে ছেঁড়া কাপড়, ঘোমটা মাথায়, ঝাঁকে ঝাঁকে জনস্রোত চলছে ভারতের উদ্দেশে। কারও হাতে টিনের কেটলি, কারও কোলে রুগ্ন শিশু, কারও পিঠে বৃদ্ধ বাবা-মা। মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকা নগ্ন পাগুলো কাদায় ডুবে গেছে। তবুও এ পথ যেন শেষ হওয়ার নয়। চারিদিক নিস্তব্ধ, কেবল থেমে থেমে শিশুর কান্নার শব্দ শোনা যায়। উদ্বাস্তুদের চেহারাই বলে দেয়, তারা কী অমানবিক অবস্থার মধ্য থেকে বেঁচে ফিরেছে। পথে মারা গেলে তাদের বয়ে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। নিহত হিন্দুদের মরদেহ পথের ধারে কিংবা নদীর পাড়ে গাছের ডাল বা শুকনো লাকড়ি দিয়ে পুড়িয়ে ছাই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নয়তো শেয়াল, কুকুর বা কাক টানছে। শরণার্থী শিবিরগুলোর অবস্থা আরও অবর্ণনীয়। বেশিরভাগ উদ্বাস্তু অসুস্থ, কারও গা কাঁথায় মোড়ানো, অনেকে কলেরায় আক্রান্ত।”
এই প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং বাংলাদেশের মানবিক সংকটের ভয়াবহতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরে।
নিউজ উইকের প্রতিবেদন
নিউজ উইক-এ সাংবাদিক টনি ক্লিফটন লেখেন:
“এখন পৃথিবীতে একজন মাত্র ব্যক্তি আছেন, যিনি পাকিস্তানকে এখনও রক্ষা করতে পারেন, তিনি হলেন শেখ মুজিব। অথচ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলছেন, মুজিবকে বিচারের মুখোমুখি করানো হবে। মুজিবকে দেশদ্রোহিতার শাস্তি পেতেই হবে। এখন যদি মুজিবের ফাঁসি হয়, তাহলে একই ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলবে পাকিস্তান।”
এই প্রতিবেদন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের গুরুত্ব এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসনের ভুল নীতির সম্ভাব্য পরিণতির উপর আলোকপাত করে।
টাইম-এ মুক্তিবাহিনীর শক্তি
টাইম ম্যাগাজিনের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়:
“মুক্তিবাহিনীর প্রায় ৫০,০০০ সৈনিক এসেছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বাঙালি পুলিশদের মধ্য থেকে। এছাড়া বহু ছাত্র গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ঢাকায় যে দুদফা গেরিলা আক্রমণ হয়েছে, তা ছাত্র গেরিলা যোদ্ধারাই চালিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত অচল করে রেখেছে। বহু জায়গায় তারা লাল, সবুজ ও হলুদ রঙে রঞ্জিত বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে।”
এই প্রতিবেদন মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং তাদের কৌশলগত সাফল্যের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ভারতে তৎপরতা
ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। ২ আগস্ট ১৯৭১-এ ভারতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে।
জাতিসংঘ মহাসচিবকে ভারতের চিঠি
জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের ২০ জুলাইয়ের স্মারকলিপির জবাবে ভারত ২ আগস্ট একটি চার পৃষ্ঠার চিঠি পাঠায়। এতে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর বলে:
“বাংলাদেশে চলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনার চেয়ে রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। শরণার্থীদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা করা জরুরি। বাংলাদেশের মূল সংকট হচ্ছে, সংখ্যালঘু সামরিক শাসক অবাধ নির্বাচনের রায় অস্বীকার করছে। বাংলাভাষী একটি জাতিকে গণহত্যা চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে। অবাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সমস্যার সমাধান হবে না, বরং মূল সমস্যাকে আড়াল করা হবে।”
ভারতের লোকসভায় বক্তব্য
- সুরেন্দ্রনাথ সিং: ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রবিষয়ক উপমন্ত্রী সুরেন্দ্রনাথ সিং লোকসভায় বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতীয় এলাকায় ও বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছিল, যা ভারত অগ্রাহ্য করেছে।
- সরদার শরণ সিং: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় ঘোষণা করেন, “মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণে যদি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে চান, তাহলে ভারত এক ইঞ্চিও ছাড় দেবে না।”
শরণার্থীদের জন্য হাসপাতাল
পশ্চিম জার্মান রেডক্রস শরণার্থীদের চিকিৎসার জন্য দ্বিতীয় ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল পাঠায়। ১০৫ শয্যার এই হাসপাতাল, যাতে অপারেশন থিয়েটার, ডিসপেনসারি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল, কলকাতায় পৌঁছায়। পশ্চিম জার্মানির অস্থায়ী কনসাল জেনারেল ডা. কে এইচ কুনা এটি ভারতীয় রেডক্রসের কাছে হস্তান্তর করেন।
বাঙালি কূটনীতিকের পদত্যাগ
দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি কর্মচারী আবদুল মজিদ এই দিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে পদত্যাগ করেন। তিনি তার নাবালক পুত্র মহিবুল মজিদকে নিয়ে হাইকমিশন ত্যাগ করেন এবং ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
বাংলাদেশ তহবিলে অনুদান
দিল্লিতে নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, লোকসভা ও রাজ্যসভার প্রত্যেক সদস্য বাংলাদেশ তহবিলে ৫০ টাকা করে অনুদান দেবেন।
জনসংঘের সত্যাগ্রহ
বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে দিল্লিতে জনসংঘের উদ্যোগে সত্যাগ্রহের দ্বিতীয় দিনে প্রায় ৭০০ সত্যাগ্রহী গ্রেপ্তার হন। তারা সংসদ ভবনের চারপাশে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় গ্রেপ্তার হন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ
যুক্তরাজ্যে উদ্বেগ
যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমেন্সে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বলেন:
“পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা পাকিস্তান সরকারকেই নিতে হবে। আমরা যত শিগগির সম্ভব একটি সমাধান দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। কেননা, সেখানকার জনগণের অনবরত দেশত্যাগ আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।”
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের হুঁশিয়ারি
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মুক্তিবাহিনীর অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। তেহরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনাল-এর সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:
“আমরা একমাত্র জাতীয় পরিষদ কর্তৃক বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার আগে কোনো ব্যক্তি বা দল বিশেষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করব না।”
তিনি আরও বলেন, মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি শিগগির ঘুরে দাঁড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে তৎপরতা
ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগকারী বাঙালি কূটনীতিক আবুল মাল আবদুল মুহিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন:
“আমরা বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনসমর্থন আদায়ের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে একটি কার্যালয় খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
২ আগস্ট ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যখন মুক্তিবাহিনী দেশজুড়ে সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বাংলাদেশের মানবিক সংকট ও মুক্তিযুদ্ধের শক্তি তুলে ধরেছিল, এবং ভারত ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন বাড়ছিল। এই দিনের ঘটনাবলি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপথে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল, যা পরবর্তীতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বিজয়ের মাধ্যমে পরিণতি লাভ করে।
তথ্যসূত্র
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)
- টাইম ম্যাগাজিন, ২ আগস্ট ১৯৭১
- নিউজ উইক, ২ আগস্ট ১৯৭১
- দৈনিক পাকিস্তান, ৩ আগস্ট ১৯৭১
- দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৩ আগস্ট ১৯৭১
- আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ৩ ও ৪ আগস্ট ১৯৭১
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও সাত
মন্তব্য করুন