দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি নৃশংস ও বেদনাদায়ক ঘটনা। এই গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার দড়িকৃষ্ণপুর গ্রামে। এই ঘটনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের হাতে ২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসী নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। এই প্রতিবেদনে দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যার পটভূমি, ঘটনার বিবরণ, শিকারদের পরিচয় এবং এর তাৎপর্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তথ্যের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (৪র্থ খণ্ড) এবং অন্যান্য গবেষণাভিত্তিক সূত্র।
দড়িকৃষ্ণপুর গ্রামের পটভূমি
দড়িকৃষ্ণপুর গ্রামটি ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা সদর উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এই গ্রামে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতেন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ এবং অন্যান্য সাধারণ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের নৃশংসতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। দড়িকৃষ্ণপুর গ্রামের অবস্থান এবং এর বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি এই গণহত্যার পটভূমি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গণহত্যার ঘটনা
১৯৭১ সালের ২রা আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তাগাছার কুখ্যাত আলবদর কমান্ডার চাঁন ও সুরুজের সহযোগিতায় দড়িকৃষ্ণপুর গ্রামে প্রবেশ করে। এই স্থানীয় সহযোগীরা পাকিস্তানি বাহিনীকে গ্রামের নিরপরাধ মানুষদের চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। পাকিস্তানি সেনারা এবং তাদের দোসররা গ্রামের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ২৮ জন নারী-পুরুষকে বেছে নিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডে কোনো বিশেষ সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করা হয়নি; বরং হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এর শিকার হয়েছিলেন। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
শিকারদের পরিচয়
দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যায় নিহত ২৮ জনের নাম এবং তাদের পিতা বা স্বামীর নাম নিম্নরূপ:
রহমত আলী মণ্ডল (পিতা: গুল মামুদ মণ্ডল)
হোসেন আলী সরকার (পিতা: উসমান আলী সরকার)
আবদুল খালেক সরকার (পিতা: উসমান আলী সরকার)
আবদুল মজিদ শেখ (পিতা: নাজির শেখ)
আবদুর রাজ্জাক (পিতা: জাহেদ আলী)
জ্যোৎস্না বেগম (পিতা: জাহেদ আলী)
আবদুল মোতালেব মণ্ডল (পিতা: গুল মামুদ মণ্ডল)
রেজিয়া খাতুন (স্বামী: আবদুল খালেক)
আম্বিয়া খাতুন (পিতা: আবদুল খালেক)
মানিকজান বিবি (স্বামী: আজগর আলী মণ্ডল)
ময়না বেগম (স্বামী: ইয়ার মামুদ)
আসাদ আলী (পিতা: লাল মামুদ)
হযরত আলী (পিতা: আসর আলী)
হাসিনা বানু (স্বামী: শের মামুদ মুন্সি)
দিলজান বিবি (স্বামী: আবদুল গণি মণ্ডল)
হাজেরা খাতুন (পিতা: আবদুল গণি মণ্ডল)
নিতাই মালী (পিতা: হণ্ডু মালী)
রাণী মালী (পিতা: হণ্ডু মালী)
হাজেরা খাতুন (স্বামী: মুনসুর আলী)
ফিরোজা খাতুন (পিতা: মুনসুর আলী)
বানেছা খাতুন (স্বামী: আহেদ আলী)
ছমেদ আলী মণ্ডল (পিতা: লাল মামুদ মণ্ডল)
ছফুরন নেছা (স্বামী: ছমেদ আলী মণ্ডল)
ইয়াদ আলী মণ্ডল (পিতা: কবির হোসেন মণ্ডল)
নজিব উদ্দিন মণ্ডল (পিতা: আবির উদ্দিন মণ্ডল)
আমেনা খাতুন (স্বামী: নজিব উদ্দিন মণ্ডল)
হাবিবুর রহমান (পিতা: ইমান আলী ক্বারি)
আমির জান (স্বামী: ইবরাহীম মুন্সি)
এই তালিকায় নিহতদের মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয়ই ছিলেন, যা এই গণহত্যার নির্বিচার প্রকৃতি প্রকাশ করে। শিকারদের মধ্যে কৃষক, গৃহিণী এবং সাধারণ গ্রামবাসী ছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকেই পরিবারের একাধিক সদস্য হারিয়েছিলেন।
গণহত্যার তাৎপর্য
দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ঘটনা শুধুমাত্র গ্রামের বাসিন্দাদের জন্যই নয়, সমগ্র মুক্তাগাছা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী আলবদর বাহিনীর এই হত্যাকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের দমননীতির অংশ ছিল। এই ঘটনা স্থানীয় জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আরও জোরদার করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধকে আরও তীব্র করে।
স্থানীয় সহযোগীদের ভূমিকা
এই গণহত্যায় স্থানীয় আলবদর কমান্ডার চাঁন ও সুরুজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয়। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে গ্রামের নিরপরাধ মানুষদের চিহ্নিত করতে সহায়তা করে এবং হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। এই স্থানীয় সহযোগীদের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের অভ্যন্তরীণ তথ্য সহজেই পেয়ে যায়, যা এই গণহত্যাকে আরও সুপরিকল্পিত করে তোলে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং লুণ্ঠনের মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করে। দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যা এই ধরনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটি। এই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা হলেও, দড়িকৃষ্ণপুরের ঘটনায় দেখা যায় যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই হত্যার শিকার হয়েছেন। এটি পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের প্রকৃতি প্রকাশ করে।
স্মৃতি রক্ষা ও শিক্ষা
দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যার শিকারদের স্মৃতি রক্ষার জন্য এই ঘটনার ইতিহাস সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। এই ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থানীয়ভাবে এই গণহত্যার স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ঘটনার ইতিহাস পড়ানোর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করা যেতে পারে।
দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের নৃশংসতার একটি মর্মান্তিক স্মারক। এই ঘটনায় ২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীর মৃত্যু শুধুমাত্র একটি গ্রামের ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের জনগণের আত্মত্যাগের প্রতীক। এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের পথে বাংলাদেশের মানুষকে কী মূল্য দিতে হয়েছিল। এই গণহত্যার শিকারদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং তাদের স্মৃতি রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
সূত্র
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ৪র্থ খণ্ড, সম্পাদক: শফিউদ্দিন তালুকদার
মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস ও সাক্ষাৎকারভিত্তিক তথ্য
মন্তব্য করুন