১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত দিকগুলোতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এছাড়াও, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ঘোষণা, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান, এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনা এই দিনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। নিম্নে এই দিনের ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, যা দুটি প্রতিবেদনের তথ্যের সমন্বয়ে সংকলিত।
ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীচুক্তি: একটি কৌশলগত পদক্ষেপ
৯ আগস্ট ১৯৭১ দিল্লিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে একটি নিয়তি-নির্ধারক পদক্ষেপ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই চুক্তি চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সমন্বিত অক্ষের বিরুদ্ধে ভারতের কৌশলগত সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির মূল বিষয় ছিল, যদি কোনো তৃতীয় দেশ ভারতের উপর আক্রমণ করে বা যুদ্ধের হুমকি দেয়, তবে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। স্পষ্টভাবে বললে, ভারত আক্রান্ত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে, এবং সাহায্যের ধরন নির্ধারিত হবে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে।
সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকো এই চুক্তিকে “যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির চুক্তি” হিসেবে অভিহিত করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় এই চুক্তির ঘোষণা দিলে সংসদে উপস্থিত জনসংঘ ও স্বতন্ত্র সদস্যদের বাদে সবাই তুমুল হর্ষধ্বনির মাধ্যমে এটিকে স্বাগত জানান। চুক্তিটি জাতিসংঘে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে, এবং যুক্তরাষ্ট্রেও এর প্রভাব পড়ে। কূটনৈতিক মহলে আলোচনা হয় যে, এই চুক্তি বাংলাদেশের ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা এবং ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান কূটনৈতিক তৎপরতার একটি জবাব।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এই চুক্তিকে স্বাগত জানায় এবং আশা প্রকাশ করে যে, এর ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের তথ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই চুক্তিকে “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আগ্রাসনের ছাড়পত্র” হিসেবে বর্ণনা করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এটিকে চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে “আক্রমণাত্মক চুক্তি” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
৯ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দপ্তর থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়, যাতে বলা হয় যে, “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও অন্যান্য অভিযোগে” বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার একটি বিশেষ সামরিক আদালতে অনুষ্ঠিত হবে। এই বিচার কার্যক্রম ১১ আগস্ট থেকে শুরু হবে এবং গোপনীয়ভাবে পরিচালিত হবে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ এবং পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগের সুবিধা দেওয়া হবে, তবে আইনজীবীকে অবশ্যই পাকিস্তানের নাগরিক হতে হবে।
এই ঘোষণা বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জন কিং জানান, কয়েক সপ্তাহ আগে শেখ মুজিবের বিচারের খবর প্রথম প্রকাশিত হলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তান সরকারের কাছে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তিনি বলেন, “মানবিক কারণে আমরা উদ্বিগ্ন। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে ব্যবস্থা গ্রহণ পূর্ব পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনার উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।”
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় শেখ মুজিবের বিচারের হুমকির গুরুতর পরিণাম সম্পর্কে পাকিস্তানকে সতর্ক করে বলেন, “এটি হবে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সারা বিশ্বের এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো উচিত।” কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিক বলেন, “বঙ্গবন্ধুর প্রাণ হননে উদ্যত পাকিস্তানকে রোখার জন্য বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ বিশ্ব জনতার সক্রিয় হস্তক্ষেপ দাবি করছে।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের একটি বিশাল সমাবেশে বলেন, “ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধী নয়। তবে ভারত ও বাংলাদেশ—এই দুই দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও কল্যাণের বিষয় নিয়েই আমরা ভাবছি। এই অঞ্চলের জনগণের স্বার্থের সব দিক ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
দেশে ও বিদেশে রাজনৈতিক ঘটনাবলি
ঢাকায় এদিন: ৯ আগস্ট কনভেনশন মুসলিম লীগের সেক্রেটারি জেনারেল মালিক মোহাম্মদ কাসেম তিনটি মুসলিম লীগকে একীভূত করার লক্ষ্যে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঐক্য জোরদার করার প্রচেষ্টার অংশ ছিল।
লন্ডনে এদিন: পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের উপপরিচালক এ কে এম আবদুর রউফ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম কমিটির একটি সভায় যোগ দেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, যা পাকিস্তানের প্রতি ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহের ইঙ্গিত দেয়।
টাঙ্গাইলে এদিন: টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে জেলা শান্তি কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন চেয়ারম্যান হাকিম হাবিবুর রহমান। সভায় জেলা শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে “শত্রুর মোকাবিলা” করার পরামর্শ দেন। তিনি দাবি করেন, “ভারতীয় ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানবিরোধী ধ্বনির উৎপত্তি হয়েছিল। এই ধ্বনির মাধ্যমে ভারত এদেশের সরলপ্রাণ জনসাধারণের মধ্যে বিদ্বেষের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে।”
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান
৯ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সেক্টরে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ তীব্রতর হয়। নিম্নে এই দিনের উল্লেখযোগ্য অভিযানগুলো তুলে ধরা হলো:
১. অপারেশন জ্যাকপট (চট্টগ্রাম): মুক্তিবাহিনীর ১ নম্বর সেক্টরের হরিণা ক্যাম্প থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ পরিচালনার জন্য ৬০ জন প্রশিক্ষিত নৌকমান্ডো মুক্তিযোদ্ধাকে তিনটি দলে ভাগ করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল স্থলপথে মিরসরাই ও চট্টগ্রাম শহর হয়ে কর্ণফুলীর পূর্ব পাড়ের চরলক্ষ্যার ঘাঁটিতে পৌঁছায়, এবং তৃতীয় দল নৌকাযোগে একই গন্তব্যে রওনা দেয়। তিনটি দলের সার্বিক কমান্ডের দায়িত্ব একজন কমান্ডারের উপর ন্যস্ত করা হয়।
২. পানিয়ারূপে অ্যামবুশ (২ নম্বর সেক্টর): ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পানিয়ারূপে পাকিস্তানি সেনাদের উপর অ্যামবুশ করে। এই অভিযানে ১৪ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অ্যামবুশ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
৩. ঝিকরগাছায় গ্রেনেড হামলা (যশোর): যশোরের ঝিকরগাছার পুলিয়ানি গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা লুটপাট করতে গেলে একজন মুক্তিযোদ্ধা একটি বাগান থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন, যাতে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
৪. লাতুতে সংঘর্ষ (সিলেট): স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি খবরে বলা হয়, সিলেটের লাতু অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৮ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে ৫৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ৬৫ জন আহত হয়। এই সংঘর্ষে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
৫. চিলমারীতে আক্রমণ (রংপুর): স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেকটি খবরে বলা হয়, রংপুরের চিলমারী থানায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন অফিসারসহ ৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশকে হত্যা করে।
৬. শাহবাজপুরে সাফল্য (সিলেট): সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলেটের উত্তরপূর্বাঞ্চলের শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৫০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ৪ জনকে আটক করা হয়।
৭. নাভারনে হামলা (যশোর): যশোরের নাভারন এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়, যাতে ৯৩ জন শত্রু নিহত এবং বহু সংখ্যক আহত হয়।
৮. সাবগ্রামে মাইন বিস্ফোরণ (বগুড়া): বগুড়ার সাবগ্রামে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে ৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ৬ জন আহত হয়। এই হামলায় একটি গাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৯. কালিবাড়ীতে সংঘর্ষ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ): চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কালিবাড়ী অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়, এবং তারা কালিবাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
১০. কাউখালী থানা আক্রমণ (পিরোজপুর): পিরোজপুরে মুক্তিবাহিনী কাউখালী থানা আক্রমণ করে এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে।
১১. কোটেশ্বরে মর্টার হামলা (কুমিল্লা-চট্টগ্রাম): কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সেক্টরের কোটেশ্বরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি অবস্থানের উপর মর্টার হামলা চালায়, যাতে ৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
তাৎপর্য ও প্রভাব
৯ আগস্ট ১৯৭১-এর ঘটনাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলে। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীচুক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এটি ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কৌশলগত শক্তি প্রদান করে এবং মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিশ্চিত করে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ঘোষণা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে এবং পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়ায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযানগুলো পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভাঙতে এবং মুক্তিযুদ্ধের গতি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই দিনের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু একটি স্থানীয় যুদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল একটি জটিল ভূরাজনৈতিক লড়াই, যেখানে দেশি-বিদেশি শক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
সূত্র - বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, ষষ্ঠ, দশম, দ্বাদশ খণ্ড। - সাপ্তাহিক জয় বাংলা, ৯ আগস্ট ১৯৭১। - দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১০ আগস্ট ১৯৭১। - দৈনিক আনন্দবাজার, ১০ আগস্ট ১৯৭১। - বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১, ২, ৬, ৭, ৮ ও ৯। - দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ আগস্ট ১৯৭১। - আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১০ ও ১১ আগস্ট ১৯৭১।
মন্তব্য করুন