১৪ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ও ঘটনাবহুল দিন। এই দিনে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক ঘটনা ঘটেছিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথকে আরও শক্তিশালী করেছিল। এই প্রতিবেদনে সেই দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, যা দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার একটি সম্মিলিত চিত্র প্রকাশ করে।
আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন
ভারতের রাষ্ট্রপতির বক্তব্য
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি দেশটির স্বাধীনতার ২৪তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে ১৪ আগস্ট জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব বা শক্তি-সাম্যের আদিম ধারণা অনুযায়ী বিশ্বের জাতিসমূহের পক্ষে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অপরিসীম এবং দীর্ঘ দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে উদাসীন থাকা অনুচিত।” তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় এক বক্তৃতায় নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করবে। ইন্দিরা গান্ধী এই দাবি খণ্ডন করে বলেন, চুক্তিতে এ ধরনের কোনো শর্ত নেই।
অন্যদিকে, ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম রাজ্যসভায় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি নিয়ে আলোচনাকালে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের একমাত্র পথ হলো স্বাধীনতা। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্পষ্টভাবে বলেছেন, স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছুতে তাঁরা সন্তুষ্ট হবেন না।” তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের উন্মাদনা বন্ধে এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির মন্তব্য
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দিল্লিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, “পাকিস্তান যে যুদ্ধে জড়াতে পারে, ভারতের এই আশঙ্কা অমূলক নয়।” শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি জানান, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমন কমার বা বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি পাকিস্তানের প্রতি শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানান।
পূর্ব জার্মানির উদ্বেগ
পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক আদালতের পদক্ষেপ আঞ্চলিক শান্তির জন্য হুমকি। তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ এবং বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জরুরি অনুরোধ জানান।
ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ভারতের আলোচনা
ইন্দোনেশিয়া সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাকার্তায় বলেন, তিনি এবং ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে একমত হয়েছেন। দুই দিনের আলোচনার পর এক যৌথ ইশতেহারে তারা শরণার্থী সমস্যা এবং এর পেছনের করুণ কাহিনি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদন
ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, পাকিস্তান শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে ভারতের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলোচনায় বসতে চায়। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে পাকিস্তান এই আশা প্রকাশ করে এবং বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর পরামর্শে ভারতের আলোচনায় রাজি হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ
ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, “শেখ মুজিব আদৌ বেঁচে আছেন কি না, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এর জবাব দিতে হবে।” তারা উল্লেখ করে যে শেখ মুজিব পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দী হওয়ার পর তাকে কেউ দেখেনি বা তার কথা শোনেনি। পত্রিকাটি সভ্য সমাজের কাছে ইয়াহিয়ার জবাবদিহির দাবি জানায়।
কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা
কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, নয়াদিল্লির একজন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শেখ মুজিবের কৌঁসুলি হিসেবে পাকিস্তানের লায়ালপুরে সামরিক আদালতে কাজ করতে ভিসার জন্য আবেদন করেছেন। দ্বিতীয় প্রতিবেদন, ‘বাংলাদেশের স্বীকৃতির দিন কি পিছিয়ে গেল?’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশের স্বীকৃতির সময়কে পিছিয়ে দিতে পারে, কারণ এই চুক্তিতে রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি অস্পষ্ট।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
ঢাকায় গেরিলা অভিযান
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকার কার্জন হলে পাকিস্তানের ঐক্য নিয়ে এক আলোচনা সভা চলাকালে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নিক্ষেপ করা বোমা বিস্ফোরিত হলে সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অন্য একটি দল তেজগাঁও, মালিবাগসহ কয়েকটি এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এই দিনে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত সভায় জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আজম বলেন, “পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে সংগ্রাম করছি।”
চট্টগ্রামে সংঘর্ষ
চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল, কমান্ডার ইলিয়াসের নেতৃত্বে, মিরসরাই হয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাওয়ার পথে মিয়াজান ঘাটে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই যুদ্ধে পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের অবস্থানে ফিরে যান।
নরসিংদীতে অতর্কিত হামলা
নরসিংদীর ঘোড়াশালের কাছে ঝিনারদি রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী একটি গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা লুটপাট করতে গেলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। তিন ঘণ্টার যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা দুটি মরদেহ ও কয়েকজন আহত সৈন্য ফেলে পালিয়ে যায়।
নোয়াখালী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আক্রমণ
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি মিলিশিয়াদের ওপর অ্যামবুশ করে। এই হামলায় একটি জিপ ধ্বংস হয় এবং ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী নুরুন্নবী গুরুতর আহত হন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে সুবেদার মেজর মজিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি অবস্থানে মর্টার হামলা চালায়, যাতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
নওগাঁয় হামলা ও গণহত্যা
নওগাঁর মহাদেবপুরের হাপুনিয়া সড়কে মুক্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা ডিনামাইটের বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ ধ্বংস হয় এবং পাঁচজন সেনা নিহত হয়। একই দিনে নওগাঁর ধামইরহাটের কুলফৎপুর গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা ১৮ জন কৃষককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে ১৪ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। গ্রামবাসী ১২ জন শহীদকে কালাহারের পুকুরপাড়ে এবং দুজনকে গ্রামের উত্তর পাড়ায় সমাধিস্ত করেন। শহীদদের মধ্যে ছিলেন তজুমুদ্দীন, বিজুমুদ্দীন, আব্বাস আলী, রহিমউদ্দীন, ফয়জুল ইসলাম, আফতাবউদ্দীন, তায়েজউদ্দীন, ছয়েফউদ্দীন, কছিমুদ্দীন, আমজাদ হোসেন, চানমুদ্দীন, অবিরউদ্দীন, মতিবুল ইসলাম ও আবেদ আলী।
কুমিল্লায় সংঘর্ষ
কুমিল্লার মাঝিগাছায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলের ওপর আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ১০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা: স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
কলকাতার রবীন্দ্রসরোবর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের সাহায্যার্থে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল তৃতীয় প্রদর্শনী খেলায় অংশ নেয়। এই ম্যাচে তারা দক্ষিণ কলকাতা স্পোর্টস ফেডারেশন দলকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে প্রথম জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করে। এর আগে তারা নদীয়ার সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করেছিল এবং গোষ্ঠ পাল একাদশের কাছে ৪-২ গোলে পরাজিত হয়েছিল। এই খেলাগুলো শরণার্থীদের সাহায্যে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৪ আগস্ট ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যেখানে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং সাংস্কৃতিক উদ্যোগ একত্রিত হয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যকে আরও জোরালো করে। ভারত, পূর্ব জার্মানি, এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সমর্থন বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অভিযান এবং সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা দেশের জনগণের মনোবল শক্তিশালী করে। এই দিনের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অমূল্য অধ্যায়।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, তিন ও সাত
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ ও ১৬ আগস্ট ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১৫ ও ১৭ আগস্ট ১৯৭১
দৈনিক যুগান্তর, ১৪ আগস্ট ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৫ আগস্ট ১৯৭১
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৪ আগস্ট ১৯৭১
মন্তব্য করুন