১৩ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযানের তীব্রতা লক্ষ্য করা যায়। এই দিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দেশি-বিদেশি প্রচেষ্টা এবং তাঁর নেতার প্রতি ন্যায়বিচারের দাবির প্রতিফলন ঘটায়।
কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ
কলকাতায় এই দিনে বাংলাদেশের শরণার্থী বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে একটি উল্লেখযোগ্য বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তি পরিষদ এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির আহ্বানে বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ মিশনের সামনে জড়ো হন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর মুক্তি কেবল বাংলাদেশের মানুষের জন্যই নয়, বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তি এবং বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য।”
সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে হত্যার চেষ্টার তীব্র নিন্দা করা হয় এবং জাতিসংঘ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টির আবেদন জানানো হয়। সভা শেষে বিক্ষোভকারীরা মিছিল সহকারে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের কনস্যুলেটে যান এবং প্রস্তাবের অনুলিপি জমা দেন। এই বিক্ষোভ ছিল বাংলাদেশের প্রবাসীদের ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রকাশ।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বঙ্গবন্ধুর বিচার বিশ্বনেতাদের এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আদায় করে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আবেদনে সাড়া দিয়ে ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠান। তিনি ইয়াহিয়াকে বঙ্গবন্ধুর বিচারে “ঔদার্য ও মানবিক বিবেচনা” প্রদর্শনের আহ্বান জানান, যা আঞ্চলিক শান্তির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেন।
যুক্তরাজ্যে, *দ্য টাইমস* পত্রিকায় হাউস অব কমন্সের দুই সদস্য পিটার শোর এবং ডব্লিউ টি উইলিয়ামসের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। তারা বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনিই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। উইলিয়ামস উল্লেখ করেন, এটি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের প্রথম প্রচেষ্টা নয়। আইয়ুব খানের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য সাজানো হয়েছিল, যা পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি ঘোষণা করেছিল। ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন সেই প্রহসনের বিচারের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া
বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্রের *ওয়াশিংটন স্টার* এবং *ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর*, তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার *বেলগ্রেড বোরবা*, এবং ইন্দোনেশিয়ার *জাকার্তা টাইমস* উল্লেখযোগ্যভাবে এই বিষয়ে মতামত প্রকাশ করে। এই পত্রিকাগুলোর মূল বক্তব্য ছিল, বঙ্গবন্ধু একজন জনপ্রিয় নির্বাচিত নেতা। তাঁর অন্যায় বিচার করা হলে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের পথ চিরতরে হারাবেন। জেনেভা থেকে ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেসও ইসলামাবাদে পাঠানো এক তারবার্তায় বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে জাতিসংঘের সনদে উল্লিখিত মানবিক বিষয়ের পরিপন্থী মন্তব্য করে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের মামলা সম্পর্কে কোনো আইনগত সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের সীমানার বাইরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, কারণ এই বিচার মানবিক উদ্বেগের সীমা অতিক্রম করেছে।”
তাজউদ্দীন আহমদের সতর্কবার্তা
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই দিনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। পাকিস্তান সরকারের কোনো অধিকার নেই বঙ্গবন্ধুর বিচার অনুষ্ঠানের। আমরা বিশ্বনেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।” এই বক্তব্য পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রবাসী সরকারের দৃঢ় অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের আহ্বানকে তুলে ধরে।
ভারতে এডওয়ার্ড কেনেডির পরিদর্শন
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থী বিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে দিল্লিতে পৌঁছান। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, “পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ভয়াবহ। এখানে চরম মানবিক বিপর্যয় চলছে। পাকিস্তান সরকার যতই লুকানোর চেষ্টা করুক, এটি এখন প্রকাশ্য। আমার ভারত সফরের উদ্দেশ্য এই মানবিক বিপর্যয় থেকে পূর্ব বাংলার মানুষকে মুক্ত করার উপায় খুঁজে বের করা।” তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে শরণার্থী সমস্যা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। কেনেডি বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে সিনেট এবং জনসাধারণের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরবেন।
ইন্দোনেশিয়ার সমর্থন
ইন্দোনেশিয়া সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এই দিনে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিকের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে শরণার্থী সমস্যা এবং ইন্দোনেশিয়ার সম্ভাব্য সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। মালিক বলেন, “বাংলাদেশের সমস্যা আন্তর্জাতিক চেহারা পাচ্ছে এবং ভারতের ওপর যে চাপ পড়ছে, তা সম্পর্কে ইন্দোনেশিয়া অবগত।” তিনি আরও বলেন, ইন্দোনেশিয়া মানবিক কারণে এই বিষয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং ইসলামি দেশগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করবে।
পাকিস্তানের প্রচারণা ও দমননীতি
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই দিনে জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের সংকট পাকিস্তানকে আরও শক্তিশালী ও গৌরবান্বিত করেছে। বিদেশি আগ্রাসী এবং নাশকতাকারীদের চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা ঐক্যবদ্ধ।” তবে, তিনি পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৪ আগস্ট সব ধরনের উৎসব, সমাবেশ ও মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ঘোষণা দেন, যা রেডিও পাকিস্তানের মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
এদিকে, ঢাকায় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক সিরাজউদ্দিন এক রাজাকার সমাবেশে বলেন, “দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে রাজাকারে যোগ দিচ্ছে। রাজাকাররা দেশ থেকে দুষ্কৃতিকারীদের উৎখাত করবে।” দিনাজপুরে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সমন্বয়ে একটি মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। সরকারি কর্মচারীদের ১৪ আগস্টের রাজাকার ও পুলিশের র্যালি ও প্যারেডে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধ
মুক্তিবাহিনী এই দিনে ঢাকা, নরসিংদী এবং কুড়িগ্রামে গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে। ঢাকার ডেমরার কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি জিপে অতর্কিত হামলা চালায়। এই অ্যামবুশে জিপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং চারজন বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা নিহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি এবং কয়েকটি রিভলভার সংগ্রহ করে।
নরসিংদীর ঘোড়াশালের কাছে ঝিনারদিতে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি গেরিলা দল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার তুমুল যুদ্ধে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১৫ জন আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, রসদ এবং অন্যান্য সামগ্রী দখল করে।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ইপিআর সদস্য কবির আহমদ শহীদ হন।
১৩ আগস্ট ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনাবহুল দিন, যেখানে বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া এবং মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধ একযোগে উঠে এসেছে। কলকাতার বিক্ষোভ, আন্তর্জাতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ, গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া এবং তাজউদ্দীন আহমদের সতর্কবার্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দেশি-বিদেশি প্রচেষ্টার ঐক্যকে প্রতিফলিত করে। একই সঙ্গে, মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের তীব্রতা প্রকাশ করে। এই দিনটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
তথ্যসূত্র:
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, তিন ও ছয়
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
- দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ আগস্ট ১৯৭১
- আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১৪ ও ১৫ আগস্ট ১৯৭১
- দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৪ আগস্ট ১৯৭১
- দ্য টাইমস, ১৩ আগস্ট ১৯৭১
মন্তব্য করুন