২০ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে রাজনৈতিক, সামরিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা সংঘটিত হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্রতা, মুক্তিবাহিনীর সাহসিকতা এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এর প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। এই প্রতিবেদনটি ২০ আগস্টের ঘটনাগুলোকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে, যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং আন্তর্জাতিক মহলের ঘটনাবলীকে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিবেদনটি প্রাথমিক সূত্রের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সকল তথ্য সঠিকভাবে সন্নিবেশিত হয়।
বাংলাদেশের ঘটনাবলী
পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসনের দমননীতি
২০ আগস্ট ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ১৩ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। এই সদস্যরা ছিলেন: নূরজাহান মোর্শেদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম ওয়ালিউল্লাহ, কাজী জহিরুল কাইয়ুম, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, খোরশেদ আলম, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ ইদ্রিস, মোস্তাফিজুর রহমান, খালেদ মোহাম্মদ আলী, খাজা আহমদ, নূরুল হক এবং মোহাম্মদ হানিফ। এই নির্দেশটি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দমন করার কঠোর প্রচেষ্টার অংশ ছিল, যার মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মুক্তি আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন
একই দিনে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বৈঠকে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়, যেখানে বলা হয়, "ভারতীয় যুদ্ধবাজ ও তাদের চরদের যোগসাজশে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্তদের দমনে সরকার যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, মজলিশে শুরা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে।" এই প্রস্তাবটি পাকিস্তানি সামরিক শাসনের প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানকে স্পষ্ট করে।
মুক্তিবাহিনীর সাফল্য
২০ আগস্ট প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে খুলনার শ্যামনগরে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কথা উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিবাহিনী তিনটি কলামে বিভক্ত হয়ে ক্যাপ্টেন হুদা, লেফটেন্যান্ট বেগ এবং নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর ও হাবিলদার সোবাহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর শ্যামনগর অবস্থানে তীব্র আক্রমণ চালায়। তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যায়, এবং শ্যামনগর মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী ৪ জন পাকিস্তানি সেনার মরদেহ উদ্ধার করে এবং ৪ জনকে আহত অবস্থায় বন্দী করে। তবে এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার ইলিয়াসসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৬ জনকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
‘জয় বাংলা’ পত্রিকার আরেকটি প্রতিবেদনে, ‘সামরিক জান্তার এখন উভয় সংকট’ শিরোনামে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গিশাহী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিচার-প্রহসনের নামে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। এই ষড়যন্ত্রে অবরুদ্ধ এলাকার জনগণের মনে তীব্র ক্ষোধ ও ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে, যার ফলে মুক্তি সংগ্রাম আরও জোরদার হয়েছে। ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে পোস্টার পড়তে শুরু করেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সামরিক জান্তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। টিক্কা খানের নেতৃত্বাধীন একটি দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পক্ষে ছিল, যখন আরেকটি দল পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। তবে, বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা উভয়ের জন্যই সংগ্রামে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে স্পষ্ট হয়েছে। ফলে, পাকিস্তানি জান্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের দ্বারস্থ হয়েছে, যারা এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১. নরসিংদীতে গেরিলা অভিযান: ২০ আগস্ট রাত ১টার দিকে নরসিংদী গেরিলা ইউনিটের ডিমোলিশন পার্টি, কমান্ডার ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে, তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন পাইপ লাইন উড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট আগুনের শিখা ১০ মাইল দূর থেকে দৃশ্যমান ছিল এবং শব্দ ৬-৭ মাইল দূর থেকে শোনা যায়। এই বিস্ফোরণের ফলে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
২. চিলমারীতে বিজয়: টানা পাঁচ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রামের চিলমারী এলাকা হানাদারমুক্ত করে। আনন্দে উদ্বেলিত জনগণ রণক্ষেত্রে এসে দেখেন শতাধিক হানাদার ও রাজাকারের মরদেহ বাঙ্কারে পড়ে আছে।
৩. কুমিল্লায় অ্যামবুশ: কুমিল্লার এক মাইল উত্তরে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ দল পাকিস্তানি হানাদারদের একটি টহলদার প্লাটুনকে অ্যামবুশ করে। অতর্কিত আক্রমণে হানাদার সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। এই অ্যামবুশে ১১ জন হানাদার নিহত এবং তিনজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা একটি মেশিনগান ও কয়েকটি জি-৩ রাইফেল দখল করে।
৪. সারিয়াকান্দিতে লঞ্চ ধ্বংস: মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মাসুদ হোসেন আলমগীর নোবেলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সারিয়াকান্দি থানার আওলাকান্দী গ্রামের পূর্ব পাশে যমুনা নদীতে হানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চ আক্রমণ করে। রকেট লাঞ্চারের আঘাতে লঞ্চটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে যায় এবং সকল হানাদার সেনা নিহত হয়।
৫. সুনামগঞ্জে আক্রমণ: কমান্ডার পাণ্ডব চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদারদের মুসলিমপুর অবস্থানে অতর্কিত হামলা চালায়। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করে জিরানপুর গ্রামে অবস্থান নেয়।
ভারতে ঘটনাবলী
২০ আগস্ট দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সুইস নিউজ এজেন্সি ও সুইস রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের দাবির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে বলেন, “যদি আমরা পাকিস্তানের সকল কথা সত্য বলে মেনেও নিই, তবে লাখ লাখ শরণার্থী কেন পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে? কী জবাব হবে এটির? তারা বাধ্য না হলে কেন তারা দেশত্যাগ করে ভিন্ন একটি দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিবে। জাতিসংঘ ওপরে ওপরে কেবল ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে। অথচ এই প্রশ্নের জবাবের বিষয়ে তারা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। যাদের কারণে তারা বাস্তুচ্যুত হয়েছে, স্বজন হারিয়েছে। তাহলে পূর্ব বাংলার মানুষ কীভাবে পূর্ববর্তী শাসকদের বিশ্বাস করবে?” এই বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুর্দশার জন্য পাকিস্তানি শাসনের দায় এবং জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করেন।
পাকিস্তানে ঘটনাবলী
মতিউর রহমানের শাহাদত
২০ আগস্ট পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে করাচীর মাসরুর বিমান ঘাঁটি থেকে সকাল ১১:১৫ মিনিটে পাঞ্জাবি পাইলট রাশেদ মিনহাজসহ একটি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিনতাই করে ভারতের দিকে উড্ডয়ন করেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে রাশেদ মিনহাজের জ্ঞান ফিরে এলে তার সঙ্গে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ধস্তাধস্তি হয়। এর ফলে সিন্ধুর বেদিনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয় এবং মতিউর রহমান দুর্ভাগ্যজনকভাবে শাহাদত বরণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়া
একই দিনে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দপ্তর থেকে একটি প্রেসনোটে বলা হয়, বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান প্রখ্যাত আইনজীবী এ কে ব্রোহীকে বিশেষ সামরিক আদালতে তার পক্ষ সমর্থনের জন্য মনোনীত করেছেন। প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়, ১১ আগস্ট শেখ মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার শুরু করেছেন। মামলার সমস্ত শুনানি গোপন রাখা হবে।
আন্তর্জাতিক মহলে ঘটনাবলী
২০ আগস্ট আফগানিস্তানের কাবুল থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘নিউ ওয়েভ’ পত্রিকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খানের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাজনীতি এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। পাকিস্তান ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতাকেও হার মানায়। পাকিস্তানি সেনারা যদি মনে করে চরম অত্যাচার ও গণহত্যার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দমিয়ে রাখতে পারবে, তবে তারা ভুল করছে। ধর্ম যে ভিন্ন সংস্কৃতির দুটি জাতির রাষ্ট্রীয় বন্ধন হতে পারে না, তা চিরকালের মতো প্রমাণিত হয়েছে।” তিনি রাওয়ালপিন্ডির পরিস্থিতির উল্লেখ করে বলেন, “দুধের কলসি ভেঙে গেছে। দুধ চারিদিকে গড়িয়ে পড়ছে। আর তারা চারপাশে বসে কাঁদছে।”
একই দিনে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সচিবালয় থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি না দিলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিণতি শুভ হবে না। আলোচনা হলে একমাত্র তাকে নিয়েই হতে পারে। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আশা করা যায়।”
২০ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল দিন হিসেবে স্মরণীয়। পাকিস্তানি সামরিক শাসনের দমননীতি, মুক্তিবাহিনীর সাহসী প্রতিরোধ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক মহলের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ এই দিনের ঘটনাগুলোতে প্রতিফলিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য, বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অদম্য চেতনাকে তুলে ধরে। এই দিনের ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
সূত্র
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: ষষ্ঠ, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
- সাপ্তাহিক জয় বাংলা, ২০ আগস্ট ১৯৭১।
- দৈনিক পাকিস্তান, ২১ আগস্ট ১৯৭১।
- দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২১ আগস্ট ১৯৭১।
মন্তব্য করুন