১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের অন্তর্গত গণ্ডগ্রাম ও ভারইল গ্রামে ১০ই আগস্ট একটি নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের হাতে ১১ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
ঘটনার প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। গফরগাঁও উপজেলার গণ্ডগ্রাম ও ভারইল গ্রামও এই নৃশংসতার শিকার হয়। এই গ্রাম দুটি রাওনা ইউনিয়নের অধীনে অবস্থিত, যা ময়মনসিংহ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
হত্যাযজ্ঞের বিবরণ
১০ই আগস্ট ১৯৭১ ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং স্থানীয় রাজাকার কাদির ও টিন মতিনের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গফরগাঁওয়ের হানাদার ক্যাম্প থেকে গণ্ডগ্রাম ও ভারইল গ্রামে হামলা চালায়। এই হামলায় তারা নির্বিচারে গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণ করে এবং নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড চালায়।
শহীদদের তালিকা ও হত্যার ধরন
১. বীরেন্দ্র দাস (গণ্ডগ্রাম): নিজ বাড়িতে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ২. আশ্বিকাচরণ দাস (গণ্ডগ্রাম): বাড়িতে থাকা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ৩. কালিয়া মোড়ল (ভারইল): গ্রামের নিজ বাড়িতে পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। ৪. ইন্তাজ আলী (ভারইল): বাড়িতে আক্রান্ত হয়ে গুলিতে শহীদ হন। ৫. রাসবিহারী মিশ্র: গফরগাঁও ইসলামিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গফরগাঁওয়ের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে লঞ্চঘাট বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ৬. নগেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক: বাগুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাকেও বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে লঞ্চঘাটে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ৭. চিত্তরঞ্জন দাস: বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে লঞ্চঘাট বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলা হয়। ৮. আবু দাস: একইভাবে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৯. পরমেশ ভৌমিক: লঞ্চঘাটে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ১০. বুদু ভৌমিক: বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে লঞ্চঘাট বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। ১১. মন্টু ভৌমিক: একইভাবে লঞ্চঘাটে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
হত্যার পদ্ধতি
হত্যাকাণ্ড দুটি ধাপে সংঘটিত হয়। প্রথমত, গণ্ডগ্রাম ও ভারইল গ্রামে সরাসরি বাড়িতে ঢুকে বীরেন্দ্র দাস, আশ্বিকাচরণ দাস, কালিয়া মোড়ল এবং ইন্তাজ আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয়ত, রাসবিহারী মিশ্র, নগেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক, চিত্তরঞ্জন দাস, আবু দাস, পরমেশ ভৌমিক, বুদু ভৌমিক এবং মন্টু ভৌমিককে তাদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গফরগাঁওয়ের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে লঞ্চঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় এবং লাশগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, যাতে প্রমাণ লোপাট করা যায়।
হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব
এই গণহত্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় রাজাকারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রাজাকার কাদির ও টিন মতিন এই হামলার নেতৃত্ব দেন। তারা গফরগাঁও হানাদার ক্যাম্প থেকে বাহিনী নিয়ে এসে এই নৃশংসতা চালায়।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য
গণ্ডগ্রাম ও ভারইল গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের নৃশংসতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই ঘটনায় শিক্ষক, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে হত্যা করা হয়, যা স্পষ্টভাবে বোঝায় যে পাকবাহিনী বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে আঘাত হানতে উদ্যত ছিল। এই ঘটনা স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিরোধের মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (৩য় খণ্ড)
মন্তব্য করুন