১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া ইউনিয়নের রামনাথ হাটে একটি নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই হত্যাযজ্ঞে ছয়জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান, যারা সকলেই পরস্পরের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে সম্পর্কিত ছিলেন। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক এবং নির্মম অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। হত্যাকাণ্ডটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয়েছিল, এবং এর পেছনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও স্থানীয় এমপিএ ফজলুল করিমের সঙ্গে শহীদদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল একটি প্রধান কারণ।
ঘটনার প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া ইউনিয়নও এই নৃশংসতার শিকার হয়। রামনাথ হাটে সংঘটিত এই গণহত্যা ছিল পাকবাহিনীর পরিকল্পিত অভিযানের একটি অংশ, যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের নির্মূল করা এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়ানো। শহীদদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ফজলুল করিমের আত্মীয়তার সম্পর্ক এই হত্যাকাণ্ডের একটি মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
হত্যাযজ্ঞের বিবরণ
১৯৭১ সালের ৮ই আগস্ট, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রুহিয়া ইউনিয়নের কানিকশালগাঁ গ্রাম থেকে ছয়জন ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায়। এই ছয়জনকে রামনাথ হাটে জনাব নুরুল ইসলামের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে পাকবাহিনী তাদের আস্তানা গড়েছিল। উল্লেখ্য, নুরুল ইসলাম ছিলেন শহীদদের নিকট আত্মীয়। এই বাসভবনেই পাকবাহিনী তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
৮ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত এই ছয়জনের উপর পাকবাহিনী নির্মম অত্যাচার চালায়। তাদের হাত-পা ও চোখ বেঁধে রাখা হয় এবং নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। ১০ আগস্ট, পাকবাহিনী তাদের গুলি করে হত্যা করে এবং লাশগুলো একসঙ্গে মাটির নিচে চাপা দেয়। এই গণকবর রামনাথ হাটের নুরুল ইসলামের বাসভবনের কাছেই অবস্থিত ছিল।
শহীদদের শনাক্তকরণ ও সমাধি
গণহত্যার পর, ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি শহীদদের লাশ শনাক্ত করা হয়। এরপর তাদের মর্যাদার সঙ্গে পুনরায় সমাধিস্থ করা হয় রামনাথ হাটে নুরুল ইসলামের বাসভবনের সামনে। এই সমাধি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের আত্মত্যাগের স্মরণ হিসেবে স্থাপিত হয়।
হত্যার কারণ
জানা যায়, এই গণহত্যার মূল কারণ ছিল শহীদদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও স্থানীয় এমপিএ ফজলুল করিমের নিকট আত্মীয়তার সম্পর্ক। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু করত। ফজলুল করিমের সঙ্গে এই ব্যক্তিদের সম্পর্কের কারণে তাদের উপর এই নৃশংস হামলা চালানো হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পাকবাহিনী স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকে দমন করার চেষ্টা করে।
হত্যার পদ্ধতি
হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত নৃশংস ও পরিকল্পিত ছিল। পাকবাহিনী প্রথমে কানিকশালগাঁ গ্রাম থেকে ছয়জনকে ধরে নিয়ে যায় এবং নুরুল ইসলামের বাসভবনে তাদের আটকে রাখে। এই সময়ের মধ্যে তাদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। তাদের হাত-পা ও চোখ বেঁধে রাখা হয়, যাতে তারা কোনো প্রতিরোধ করতে না পারে। ১০ই আগস্ট, তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় এবং লাশগুলো একত্রে মাটির নিচে চাপা দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ লুকানোর একটি কৌশল ছিল।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য
রুহিয়ার রামনাথ হাটের গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই ঘটনা কেবল স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভয় ও শোক ছড়ায়নি, বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের প্রতিরোধের মনোভাবকে আরও শক্তিশালী করেছে। শহীদদের সঙ্গে ফজলুল করিমের সম্পর্ক এই হত্যাকাণ্ডকে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের উপর পাকবাহিনীর নির্বিচার আক্রমণের একটি প্রমাণ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
সূত্র: মোহাম্মদ এমদাদুল হকের লেখা এবং মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড)
মন্তব্য করুন