২১ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে কূটনৈতিক বিদ্রোহ, গেরিলা অভিযান, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য তীব্র আহ্বান সহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। এই প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ), পাকিস্তান, ভারত এবং আন্তর্জাতিক মহলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর একটি বিস্তৃত বিবরণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
কূটনৈতিক বিদ্রোহ: এ এফ এম আবুল ফতেহের পদত্যাগ
২১ আগস্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ইরাকে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এ এফ এম আবুল ফতেহের পদত্যাগ। তিনি এই দিনে লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। আবুল ফতেহ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেওয়া সর্বোচ্চ পদস্থ বাঙালি কূটনীতিক। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে চলমান “প্রহসনমূলক বিচার” তাকে আর ধৈর্য ধরে থাকতে দেয়নি। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তিনি ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর আগে তিনি প্যারিস, ওয়াশিংটন, প্রাগ, দিল্লি এবং কলকাতায় কূটনীতিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান দূতাবাসের চ্যান্সেলর এবং পরে উপ-রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ইরাকে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি দুই বছর কলকাতায় উপ-রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পদত্যাগের পর তিনি লন্ডনে ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। বিচারপতি চৌধুরী তারবার্তার মাধ্যমে এই সংবাদ মুজিবনগর সরকারের কাছে পাঠান। এই দিনে আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো আপস নেই।” তিনি স্পষ্টভাবে তিনটি শর্ত উল্লেখ করেন: ১. পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কর্তৃক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি। ২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি। ৩. বাংলাদেশের মাটি থেকে সকল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা অপসারণ। তিনি আরও বলেন, “ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর গণহত্যায় লাখ লাখ প্রাণ কোরবানি হয়েছে। সে ত্যাগ আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। শহীদদের আমরা ভুলতে পারি না।”
ঢাকায় গেরিলা অভিযান
এই দিনে ঢাকায় গেরিলা যোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সাহসী অভিযান পরিচালনা করে। এম এ আজিজের নেতৃত্বে গেরিলা দল, যার মধ্যে ছিলেন আব্দুল্লাহ, মেহমুদ, মান্নান, দুলাল, ইন্ডিয়ান ফারুক এবং খালেদ, গ্রীন রোডের মাঝামাঝি অংশে একটি একতলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে আক্রমণ চালায়। তারা পূর্বে রাস্তায় বিছিয়ে রাখা মাইন, গ্রেনেড এবং গুলি ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ট্রাক ও একটি জিপ ধ্বংস করে। পরদিন বিবিসি রেডিওতে প্রচারিত সংবাদে বলা হয়, এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর দুইজন কর্নেল, দুইজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৩ জন নিহত এবং ৪২ জন আহত হয়। অপারেশন শেষে গেরিলারা নির্বিঘ্নে তাদের গোপন আস্তানায় ফিরে যায়।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ
২১ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন আনসার অধ্যাদেশ ১৯৪৮ বাতিল করে ‘রাজাকার অধ্যাদেশ ১৯৭১’ জারি করে। এর মাধ্যমে আনসার বাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং আনসার অ্যাডজুট্যান্টদের রাজাকার অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে পরিণত করা হয়। অধ্যাদেশের ব্যাখ্যায় বলা হয়, রাজাকার বাহিনীতে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করবে। এছাড়াও, প্রাদেশিক সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাজাকারদের প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
একই দিনে, পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব মাহমুদুল হক ওসমানিকে গ্রেপ্তার করে। তাকে সামরিক আদালতে হাজির করা হলে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে কথা বলার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিষদ এই দিনে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার বন্ধের আহ্বানের সমালোচনা করে। তারা বলে, “জাতিসংঘ মহাসচিব এ ব্যাপারে ক্ষমতা বহির্ভূত হস্তক্ষেপ করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার পাকিস্তান সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়।” জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে মওলানা আবদুর রহিম আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীর তৎপরতা যথেষ্ট নয়। অপতৎপরতায় লিপ্তদের বিরুদ্ধে ৬০ ও ৭৮ নং সামরিক বিধি আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হোক।”
ভারতে আন্তর্জাতিক সমর্থন
ভারতের দিল্লিতে এই দিনে পূর্ব জার্মানির সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ড. আর জিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পূর্ব বাংলার মানুষের দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে এর স্থায়ী সমাধান সম্ভব। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এখন অপরিহার্য, কারণ তাকে ছাড়া তারা কোনো বৈঠকে বসতে আগ্রহী নয়।” তিনি শরণার্থী শিবিরে পৈশাচিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “এই নির্মমতা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।”
আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক মহলে এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি তীব্র হয়। মার্কিন সিনেটর চার্লস পার্সি মার্কিন সিনেটে বলেন, “পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানকে আর জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। বাঙালি জাতির ইস্পাত কঠিন সংকল্প অত্যন্ত মহৎ। শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন যদি আর এক পা এগোয়, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে।” তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রাণদণ্ড হলে “পৃথিবীর কেউ তাদের ক্ষমা করবে না।”
কানাডার টরন্টোতে অক্সফাম আয়োজিত দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানান। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারের নিন্দা করে বলা হয়, “এটি মানবতাবিরোধী। এর ফলে বাংলার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।” হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মার্কিন বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন এবং গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানান। তারা বলেন, “পাকিস্তানের নির্মমতা ইতিহাসে বিরল। সাত মিলিয়ন মানুষ প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, অথচ পাকিস্তান সামরিক প্রশাসন তাদেরই দোষারোপ করছে।”
সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন এই দিনে বলেন, “ইয়াহিয়া খানের সরকার পূর্ব বাংলাকে শ্মশান বানিয়েছে এবং এখন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর দুঃসাহস দেখাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ পাকিস্তানের জন্য আত্মহত্যার সমান হবে।”
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২১ আগস্ট মুক্তিবাহিনী দেশব্যাপী একাধিক গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে। কুমিল্লার উত্তরে গাজীপুর রেলওয়ে সেতুর কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি টহলদল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে একজন লেফটেন্যান্টসহ ছয়জন হানাদার নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ দখল করে।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সরবরাহ ঘাঁটিতে হামলা চালায়, যাতে ৭০ জন হানাদার নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়।
নরসিংদীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলে গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রায় এক ঘণ্টার গোলাগুলির পর হানাদাররা পিছু হটে।
সুন্দরবনে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, যাতে হানাদারদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
খুলনার শ্যামনগরে মুক্তিবাহিনী ক্যাপ্টেন হুদা, লে. বেগ, নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর এবং হাবিলদার সোবাহানের নেতৃত্বে তিনটি কলামে আক্রমণ চালায়। তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান ত্যাগ করে এবং শ্যামনগর মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এই সংঘর্ষে চারজন পাকিস্তানি সেনার লাশ উদ্ধার হয় এবং চারজনকে আহত অবস্থায় বন্দী করা হয়। তবে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার ইলিয়াসসহ আটজন শহীদ হন এবং ছয়জনকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়।
২১ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত। এ এফ এম আবুল ফতেহের পদত্যাগ এবং বাংলাদেশের পক্ষে যোগদান কূটনৈতিক মোর্চায় একটি বড় ধাক্কা ছিল। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযানগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে কোণঠাসা করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান সমর্থন বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে আরও জোরালো করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি এই দিনে দেশ-বিদেশে তীব্রভাবে উত্থাপিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পথকে আরও সুগম করে।
সূত্র:
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: পঞ্চম, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও আট।
- মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
- দৈনিক পাকিস্তান, ২২ আগস্ট ১৯৭১।
- দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২২ আগস্ট ১৯৭১।
- আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ২২, ২৩ ও ২৪ আগস্ট ১৯৭১।
- জয়বাংলা পত্রিকা, ২১ আগস্ট ১৯৭১।
মন্তব্য করুন