২৫ আগস্ট মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "মুক্তিবাহিনী জল, স্থল ও আকাশপথে হানাদার বাহিনীকে আঘাত করছে। তার প্রমাণ একদিনে অনেকগুলো জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া। মুক্তিবাহিনী অনেক স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলায় অনেক স্থানে রেল চলাচল বন্ধ। আমরা হানাদারদের বিদায়ের পূর্ব পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবো।" এই ঘোষণা মুক্তিবাহিনীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের ক্রমাগত প্রতিরোধের প্রমাণ বহন করে।
একই দিনে মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা খুলনার মোংলা বন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ‘পদ্মা’ ডুবিয়ে দিয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, মোংলা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য নদীবন্দরে বেশ কয়েকটি নৌযান ধ্বংস করা হয়েছে। এই সফল অভিযানগুলো পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক ধাক্কা দেয়।
ঢাকায় এই দিনে ক্র্যাক প্লাটুনের একটি গেরিলা দল ‘অপারেশন আননোন’ নামে একটি দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে। ছিনতাই করা একটি গাড়িতে করে ধানমণ্ডির ৫ ও ১৮ নম্বর সড়কে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের বাড়ির সামনে ঝটিকা আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। এই আক্রমণে ৭ থেকে ৮ জন পাকিস্তানি হানাদার সেনা নিহত হয়। এই ঘটনা ঢাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মুক্তিবাহিনীর সাহস ও কৌশলের প্রশংসা কুড়ায়।
২৫ আগস্ট পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান, "কয়েকটি নতুন সমস্যাসহ পাকিস্তান যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সেসব নিয়ে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেছি। দেশের স্বার্থেই আমরা সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবো বলে আশা করি।" এই বৈঠক পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ইঙ্গিত দেয়।
আন্তর্জাতিক মহলে এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট-এ স্টিফেন ক্লাইভম্যানের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে নিক্সন সরকারের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়, "ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রক্ষা করাই মার্কিন সরকারের নীতি।" এই অবস্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সমর্থনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে।
২৫ আগস্ট কুমিল্লার উত্তরে জামবাড়িতে ক্যাপ্টেন দিদারুল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি কোম্পানির উপর অতর্কিত মর্টার হামলা চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালানোর চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ দল মর্টার ও গুলিবর্ষণ করে। এতে ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। বাকি সেনারা পালিয়ে যায়।
একই দিনে কুমিল্লার সি এন্ড বি সড়কে মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশ দল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ডজ গাড়ি আক্রমণ করে। এই অ্যামবুশে একজন হাবিলদারসহ ৪ জন হানাদার সেনাকে আটক করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা গাড়ি থেকে ৬টি রাইফেল, ২২৫ রাউন্ড গুলি, ২টি পিস্তল এবং ৩টি গ্রেনেড উদ্ধার করে।
সিলেটের কুকিতল সাব-সেক্টরে আতিকুল হক পনীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর দিলখুশা ক্যাম্পের ২০০ গজ এলাকায় অ্যামবুশ পরিচালনা করে। ভোরে আজানের কিছুক্ষণ পরে, যখন হানাদার সেনারা একে একে বাঙ্কার থেকে বের হচ্ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই অভিযানে ৬ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে ধানদইল গ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি প্লাটুনের উপর মুক্তিবাহিনীর একটি পেট্রোল দল অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় একজন ক্যাপ্টেনসহ ১০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। বাকি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।
যশোরের বারিনগরে মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৬ জন রাজাকার নিহত এবং ৩ জন আহত হয়। এই অভিযানে মুক্তিবাহিনী ২টি রাইফেল উদ্ধার করে। একই সঙ্গে বারিনগরে আরেকটি রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালানো হলে ১৪ জন রাজাকার আহত এবং ৮ জনকে আটক করা হয়। এই অভিযানে মুক্তিবাহিনী ১৫টি রাইফেল জব্দ করে।
অন্যদিকে, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের কাকড়াবুনিয়া বাজারে রাজাকার ফোরকান মল্লিক ও তার সশস্ত্র সঙ্গীরা চারজনকে হত্যা করে। ফোরকান মল্লিক এবং তার সহযোগী রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার সেনারা গ্রামজুড়ে গণহত্যা, জখম, আটক, ধর্ষণ, লুটপাট এবং গানপাউডার ব্যবহার করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এই নৃশংসতা স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ভয়ের সৃষ্টি করে।
২৫ আগস্ট ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক দিন। মুক্তিবাহিনীর দৃঢ়তা, সাহসিকতা এবং কৌশলগত অভিযান এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। মুজিবনগর থেকে প্রবাসী সরকারের ঘোষণা এবং ঢাকায় গেরিলা অভিযান মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা এবং জনগণের মুক্তির প্রতি অটল প্রতিজ্ঞাকে প্রকাশ করে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহল ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এই যুদ্ধের বিশ্বব্যাপী প্রভাবকে তুলে ধরে। এই দিনের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, ষষ্ঠ, দশম, ত্রয়োদশ খণ্ড।
দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ আগস্ট ১৯৭১।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৬ আগস্ট ১৯৭১।
মন্তব্য করুন