১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং কূটনৈতিক তৎপরতা তীব্র আকার ধারণ করে। ঢাকায় সামরিক আদালতের নির্দেশ, মুক্তিবাহিনীর সাহসী অপারেশন, ভারতে সমর্থনমূলক বিবৃতি, আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদন—সব মিলিয়ে এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের গতিপথে একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত হিসেবে দাঁড়ায়। নিম্নে এই দিনের বিস্তারিত ঘটনাবলি তুলে ধরা হলো।
ঢাকায় সামরিক আদালতের নির্দেশ
১৯ আগস্ট ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক আইন প্রশাসক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগের ২৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করেন। এই নির্দেশ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দমন করার একটি কৌশল। নির্দেশপ্রাপ্ত সদস্যরা ছিলেন: আবদুল মমিন, আবদুল হামিদ, জিল্লুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মৌলভী হুমায়ুন খালিদ, শামসুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আলী আজম, আবদুস সামাদ আজাদ, মোহাম্মদ আবদুর রব, মোস্তফা আলী, এ কে লতিফুর রহমান চৌধুরী মানিক, দেওয়ান ফরিদ গাজী, মোহাম্মদ ইলিয়াস, ফজলুর রহমান, এ কে শামসুজ্জোহা, আবদুল করিম ব্যাপারী, এ ভুঁইয়া, শামসুল হক, কে এম ওবায়দুর রহমান, মোল্লা জালাল উদ্দিন, শামসুদ্দিন মোল্লা, এম এ গফুর, শেখ আবদুল আজিজ, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এ মান্নান হাওলাদার, আবদুর রব সেরানিয়াবাত এবং এনায়েত হোসেন খান। এই নির্দেশ পাকিস্তানি জান্তার রাজনৈতিক দমননীতির একটি স্পষ্ট প্রতিফলন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার
এই দিনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘বিশ্ব জনমত’-এ পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমালোচনার খবর প্রচারিত হয়। পাকিস্তানের সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে চলমান প্রহসনের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে হুঁশিয়ার করে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা এবং শেখ মুজিবের বিচারের নামে প্রহসনের ফলে পাকিস্তান নিজেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। এছাড়া, অনুষ্ঠানে জানানো হয়, পাকিস্তানি জাহাজ ‘আল-আহমাদী’ মার্কিন সমরাস্ত্র বহনের জন্য ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পাকিস্তানি জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীরা ছোট ছোট নৌযান দিয়ে জাহাজটির পথে অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে জাহাজটি ফিলাডেলফিয়া ছেড়ে বাল্টিমোরের দিকে অগ্রসর হয়।
ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অপারেশন
এই দিন ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় হাবিব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা মাহবুব আহমদ শহীদের নেতৃত্বে একটি সাহসী অপারেশন পরিচালনা করে। সকাল ১১টার দিকে তারা একটি টয়োটা গাড়িতে ১০ পাউন্ড বিস্ফোরক বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে বেশ কয়েকটি গাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। এই অপারেশন পাকিস্তানি শাসনের অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর আঘাত হানার একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা ছিল।
দেশব্যাপী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ
১৯ আগস্ট মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী অপারেশন চালায়। নিম্নে এই দিনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশনের বিবরণ দেওয়া হলো:
কুড়িগ্রামের চিলমারী: সন্ধ্যায় মেজর জামিলের নেতৃত্বে থার্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাঙ্কারে ঢুকে চারজন হানাদার সৈন্যকে হত্যা করে। রাতে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি হামলা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছু নেয়। ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাঙ্কার, পজিশন এবং ডিফেন্স লাইনে প্রবেশ করে। প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটতে গিয়ে প্রায় ৭০০ হানাদার সৈন্য চিলমারী রেলওয়ে স্টেশনের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশের শিকার হয়। এতে বহু হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
সাঁটুরিয়া থানা: মুক্তিবাহিনী এই থানায় অতর্কিত হামলা চালায়, যাতে ৪ জন হানাদার সেনা ও ৫ জন পুলিশ নিহত হয়। এ সময় ১৪ জন হানাদার সেনাকে আটক করা হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে।
ময়মনসিংহ-সিলেট-মৌলভীবাজার সেক্টর: কামালপুরের কাছে মুক্তিবাহিনী একটি সেতু উড়িয়ে দেয় এবং পাহারারত রাজাকারদের হত্যা করে।
শালদা নদী: দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর তিনটি নৌকা শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনী ছোট নাগাইশের কাছে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে দুটি নৌকা ডুবে যায় এবং ২০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। পিছনের নৌকাটি পাড়ে ভিড়লে হানাদার সেনারা পাল্টা হামলা চালায়, কিন্তু চার ঘণ্টার যুদ্ধের পর তারা পিছু হটে।
কুমিল্লা: বেলা ১টায় মুক্তিবাহিনীর কামানের গোলায় শালদা নদী গুদামের একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়, যাতে ৮ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
খুলনার পাইকগাছা: মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর একটি লঞ্চে অ্যামবুশ করে, যাতে ২৬ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন
ভারতে এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উল্লেখযোগ্য সমর্থন প্রকাশিত হয়। কলকাতায় অপারেশন ওমেগার সদস্য ড্যানিয়েল গ্রোটা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের আটক করার সময় স্বৈরাচারের পরিচয় দিয়েছে। তিনি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা জ্বালিয়ে দেওয়া ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেন এবং জানান, সাধারণ মানুষের ত্রাণের প্রয়োজন। তিনি বলেন, তাদের প্রথম যাত্রা সফল না হলেও তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে সফল হয়েছেন।
ভারতীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও লোকসভার সদস্য ইব্রাহিম সুলেমান সাইফ এক বিবৃতিতে বলেন, ভারত সরকার যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তবে মুসলিম লীগ এবং ভারতের ৮ কোটির বেশি মুসলমান সরকারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে। তিনি পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতাকে ‘পৈশাচিক ও বর্বর’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
পশ্চিমবঙ্গ শান্তি সংসদ আয়োজিত এক সভায় গায়ানার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছেদি জগন বলেন, বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ। তিনি পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের জয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘোষণা
পাকিস্তান সরকার এই দিনে ঘোষণা করে, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত ৯৪ জন সদস্যের সদস্যপদ ব্যক্তিগতভাবে বহাল থাকবে। এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কৌশল, যদিও এটি বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার দাবিকে দমাতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক মহলে এই দিনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রবার্ট ম্যাকক্লক্সি বলেন, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে মার্কিন সরকার একমত নয়। তবে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানান, পাকিস্তানকে লিজ দেওয়া দুটি বোয়িং বিমান সামরিক পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, তা তদন্ত করা হচ্ছে।
ফিলাডেলফিয়ায় ছয়জন বাঙালি নাবিক একটি পাকিস্তানি জাহাজ থেকে পালিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। তাদের পক্ষে ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের মুখপাত্র রিচার্ড টেইলার আবেদন করেন।
নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হৃষিকেশ শাহ বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার ন্যায় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ নীতির পরিপন্থী এবং এটি বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে বাধা। তিনি শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানান।
জাতিসংঘের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার বিরোধী। সোভিয়েত প্রতিনিধি ভিকটর ইসরায়েলিয়ান জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাতে বলেন, পাকিস্তানই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী এবং পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন
১৯ আগস্ট ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই উদ্যোগ সমর্থন করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান মোহাম্মদ খান তেহরানে পৌঁছেছেন।
‘ইন্ডিয়া নিউজ’-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের সম্ভাবনা নাকচ করেন এবং চার দফা দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন: ১. শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি, ২. বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার, ৩. পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্ষতিপূরণ, এবং ৪. বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম ঘোষণা।
‘নিউ টাইমস’ পত্রিকায় বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহান শেখ মুজিবের বিচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইয়াহিয়া খানকে চিঠি লিখেছেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবের বিচার পাকিস্তানের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করবে এবং এটি জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
১৯ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল দিন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমননীতি, মুক্তিবাহিনীর সাহসী প্রতিরোধ, ভারত ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এই দিনের ঘটনাবলিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনগণের অবিচল সংগ্রাম এবং বিশ্বের সমর্থন এই দিনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: পঞ্চম, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান, ২০ আগস্ট ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২০ আগস্ট ১৯৭১
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৯ আগস্ট ১৯৭১
ইন্ডিয়া নিউজ, ১৯ আগস্ট ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ২০ ও ২১ আগস্ট ১৯৭১
দ্য টাইমস, ২০ আগস্ট ১৯৭১
দ্য গার্ডিয়ান, ১৯ আগস্ট ১৯৭১
মন্তব্য করুন