১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় মেহেরপুর জেলার বাড়িবাঁকা ও বুড়িপোতা গ্রামে একটি নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই ঘটনা ঘটে ১০ আগস্ট ১৯৭১, যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় এই গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। এই হত্যাযজ্ঞে চারজন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিন দিন নির্যাতনের পর মেহেরপুর কলেজের পেছনের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে স্থান পেয়েছে।
ঘটনার প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ ও নির্যাতন চালায়। মেহেরপুর জেলা, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল, সেখানেও পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা ব্যাপক নৃশংসতা চালায়। বাড়িবাঁকা ও বুড়িপোতা গ্রামে সংঘটিত এই গণহত্যা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের একটি অংশ, যার উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়ানো এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ দমন করা।
হত্যাযজ্ঞের বিবরণ
১০ই আগস্ট ১৯৭১, মেহেরপুর কলেজ ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় বাড়িবাঁকা ও বুড়িপোতা গ্রামে অভিযান চালায়। এই অভিযানে তারা গ্রাম থেকে চারজন নিরীহ বাসিন্দাকে ধরে নিয়ে যায়। এই চারজনকে মেহেরপুর কলেজ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাদের তিন দিন ধরে নির্মম নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের পর তাদের মেহেরপুর কলেজের পেছনে অবস্থিত একটি বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হত্যার পদ্ধতি
পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকাররা পরিকল্পিতভাবে গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে চারজনকে বেছে নেয়। এই ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট পরিচয় সূত্রে উল্লেখ করা না হলেও, তারা গ্রামের সাধারণ বাসিন্দা ছিলেন। ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের কলেজ ক্যাম্পে তিন দিন ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এই নির্যাতনের মধ্যে ছিল শারীরিক প্রহার, অমানবিক আচরণ এবং সম্ভবত জিজ্ঞাসাবাদ। তিন দিন পর, তাদের কলেজের পেছনের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই বধ্যভূমি পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য একটি নির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যেখানে তারা তাদের শিকারদের লাশ লুকানোর চেষ্টা করত।
হত্যাকাণ্ডে রাজাকারদের ভূমিকা
স্থানীয় রাজাকাররা এই গণহত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তারা গ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে পাকবাহিনীকে তথ্য সরবরাহ করে এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। রাজাকারদের এই সহযোগিতা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতাকে আরও কার্যকর করার একটি প্রধান কারণ। তাদের স্থানীয় জ্ঞান ও সহযোগিতার কারণে গ্রামবাসীদের জন্য পালানো বা আত্মরক্ষা করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য
বাড়িবাঁকা গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের নৃশংসতার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। এই ঘটনা শুধুমাত্র স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়ায়নি, বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের প্রতিরোধের মনোভাবকে আরও দৃঢ় করেছে। মেহেরপুর, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের স্থান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেখানে এই ধরনের নৃশংসতা স্থানীয় জনগণের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের দৃঢ়তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
সূত্র: মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড)
মন্তব্য করুন