১৯৭১ সালের ২৬ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ মহলে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছিল, যা পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং শরণার্থী সংকটের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এই প্রতিবেদনে ২৬ আগস্টের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা কূটনৈতিক, সামরিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংঘাতের জটিলতা প্রকাশ করে।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি: এডওয়ার্ড কেনেডি ও রিচার্ড নিক্সনের সাক্ষাৎ
২৬ আগস্ট মার্কিন সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এবং প্রভাবশালী সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারত সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে তিনি এই সাক্ষাতে ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের ওপর চরম অমানবিকতার চিত্র তুলে ধরেন। গত এক সপ্তাহ ধরে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেন, “আপনি ভাবতেও পারবেন না মানুষ মানুষের সঙ্গে এই ধরনের আচরণ করতে পারে। গ্রামের পর গ্রাম, জনপদের পর জনপদ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শরণার্থীরা মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত, কারণ তারা যে অবস্থা থেকে পালিয়ে এসেছে, তা কেবল তারাই জানে। পূর্ব বাংলায় তাদের ওপর যে পৈশাচিকতা ও বর্বরতা চালানো হয়েছে, তা ইতিহাসে বিরল। নিরীহ মানুষের ওপর নির্মমভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছে। প্রাণে বাঁচতে তারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।”
কেনেডি আরও বলেন যে, এই গণহত্যা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের জন্য প্রধানত পাকিস্তান সরকার দায়ী। তিনি মার্কিন সরকারের পাকিস্তানকে দেওয়া সামরিক সাহায্যের সমালোচনা করে বলেন, “আমরা যে সামরিক সাহায্য পাকিস্তানকে দিয়েছি, সেই শক্তি তারা পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগ করছে।” তিনি পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান, যা আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরবর্তীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় কেনেডি আরও কঠোরভাবে বলেন, “পাকিস্তানকে এখনো সমরাস্ত্র সহায়তা দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। যাদের কাছে নিজ দেশের মানুষের কোনো মূল্য নেই, তাদের প্রতি এই সমর্থন অমানবিক। পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে, তাতে কোনো বিবেকবান মানুষ চুপ থাকতে পারে না।” তিনি মার্কিন সরকারের প্রতি পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সহায়তা বন্ধ করার এবং শরণার্থী সমস্যা সমাধানে কাজ করার আহ্বান জানান।
ভারত সফরের সময় কেনেডি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে নিক্সনকে অবহিত করেন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনা
ঢাকায় রাজনৈতিক বক্তব্য: এদিন ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি শামসুল হুদা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা দেখে দুষ্কৃতকারীদের দমন করুন। এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এদের দমন করতে আরও কঠোর হন।” এই বক্তব্য পাকিস্তানি প্রশাসনের প্রতি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়, যা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের কঠোর অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।
রাওয়ালপিন্ডিতে আলোচনা: পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাক্ষাৎ করেন। তারা পরিস্থিতি অনুকূলে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া, ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চার সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা ব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পিপিপির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা শাসনতান্ত্রিক বিষয় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা করেছি। শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে সবার ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রয়োজন।” এই আলোচনা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে ইঙ্গিত করে।
আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া
বুয়েন্স এইরেসে শরণার্থীদের জন্য অনুষ্ঠান: আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেসে এদিন পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের সাহায্যার্থে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যুদ্ধবিরোধী নাগরিক সমাজ। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং সালভাদর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার কুইয়েসের নেতৃত্বে এই অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে শান্তি ও যুদ্ধবিরোধী বার্তা নিয়ে গান, নাচ ও কবিতা আবৃত্তি করা হয়। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। এই অনুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ রেডক্রসের তহবিলে জমা দেওয়া হয়, যা শরণার্থীদের সহায়তায় ব্যবহৃত হয়।
সংবাদপত্রে প্রতিবেদন
ইস্ট আফ্রিকান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার একটি অভিমত এদিন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় “নয়াদিল্লী ও কলিকাতা হইতেই মুজিবকে সমর্থন দেওয়া হয়” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, পত্রিকার সম্পাদক সম্প্রতি পাকিস্তান সফর করে পাঠকদের সামনে একটি নিরপেক্ষ বিবরণ তুলে ধরেছেন। তিনি দাবি করেন, নয়াদিল্লি ও কলকাতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারণাকে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে, যা পাকিস্তানকে খণ্ডবিখণ্ড করার ভারতের পরিকল্পনার অংশ। এই প্রতিবেদন পাকিস্তানের প্রচারণার অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মতামত গঠনের প্রয়াসকে প্রতিফলিত করে।
এছাড়া, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় পিপিআইএ এবং এএফপি সূত্রে “প্রেসিডেন্টের নিকট বন্দরনায়েকের পত্র” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মিসেস বন্দরনায়েক ২৫ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি পত্রে পাক-ভারত উপমহাদেশে উত্তেজনা রোধ এবং শান্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর সম্মতি প্রকাশ করেছেন। তবে, এই প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যায় মধ্যস্থতার জন্য নয় বলে উল্লেখ করা হয়।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৬ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। এই দিনের উল্লেখযোগ্য সামরিক অভিযানগুলো নিম্নরূপ:
কুমিল্লায় হামলা: কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার কাছে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছয়টি নৌকার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। পালিয়ে যাওয়ার সময় নাগাইশে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার নজরুলের নেতৃত্বে আরেকটি হামলায় ১৮ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন শহীদ হন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে অভিযান: ৭ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মজিদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দুটি দল কানসাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। তীব্র আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী কানসাট ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তবে, পরে তারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে কানসাটে আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে।
ময়মনসিংহে আক্রমণ: ময়মনসিংহের ভালুকায় কমান্ডার আইয়ুব আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মল্লিকবাড়ি ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ৮ জন হানাদার সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
রাজশাহীতে সংঘর্ষ: রাজশাহীর দুর্গাপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর একটি দলের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী মর্টার ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায়।
ফেনীতে মর্টার হামলা: ফেনীর ছাগনাইয়ায় মুক্তিবাহিনী আমজাদহাট প্রতিরক্ষাব্যূহের ওপর মর্টার হামলা চালায়। প্রাথমিকভাবে হানাদার বাহিনী পাল্টা জবাব দিলেও পরে তারা অস্ত্র ও রসদ ফেলে মুহুরী নদী পার হয়ে পালিয়ে যায়।
টাঙ্গাইলে সংঘর্ষ: টাঙ্গাইলের জলপাই গ্রামে কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং একজনকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়।
২৬ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এডওয়ার্ড কেনেডির মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের সক্রিয়তা এবং বুয়েন্স এইরেসের মতো দূরবর্তী স্থানে শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ শরণার্থী সংকটের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে। একই সঙ্গে, মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের অবিচল সংগ্রামের প্রমাণ বহন করে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আলোচনা এবং সংবাদপত্রে প্রচারিত প্রতিবেদনগুলো এই সংকটের জটিলতা এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবকে তুলে ধরে। এই সকল ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ আগস্ট ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ আগস্ট ১৯৭১
নিউইয়র্ক টাইমস, ২৭ আগস্ট ১৯৭১
মন্তব্য করুন