১৯৭১ সালের ২৬ আগস্ট মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানার বিষ্ণুপুর গ্রামে সংঘটিত হয় কুণ্ডুবাড়ি হত্যাকাণ্ড, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি নৃশংস ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের হাতে কুণ্ডুবাড়ির একই পরিবারের তিনজন সদস্য নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। এই ঘটনা শুধু কুণ্ডু পরিবারের জন্যই নয়, সমগ্র বিষ্ণুপুর গ্রামের জন্য একটি অবিস্মরণীয় ট্র্যাজেডি।
ঘটনার পটভূমি
বিষ্ণুপুর গ্রাম, যেখানে জনসংখ্যার অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের, দৌলতপুর থানার কাছাকাছি অবস্থিত। গ্রামের কুণ্ডুবাড়ি ছিল একটি সম্ভ্রান্ত ও বিলাসবহুল বাড়ি, যেখানে পরিবারের সদস্যরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের নৃশংসতার শিকার হয় এই পরিবার।
২৫ আগস্ট রাতে, যখন কুণ্ডুবাড়ির সদস্যরা গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলেন, তখন ধলেশ্বরী নদীর গজঘাটা নামক স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বহনকারী একটি পানসি নৌকা ভিড়ে। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য কলিমুদ্দি (খলসী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান) এবং মোসলেম উদ্দিনের সহযোগিতায় তারা কুণ্ডুবাড়ির অবস্থান নিশ্চিত করে। কিছুক্ষণের মধ্যে পানসি নৌকাটি কুণ্ডুবাড়ির কাছে পৌঁছে যায়।
হানাদারদের আক্রমণ ও লুটপাট
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা নৌকা থেকে নেমে বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। গুলির শব্দে গ্রামের মানুষের ঘুম ভেঙে যায় এবং কুণ্ডুবাড়িসহ সমগ্র বিষ্ণুপুর গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ আর্তচিৎকার করে এলোপাতাড়ি ছুটাছুটি শুরু করে। কুণ্ডুবাড়ির নারী ও শিশুরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও পুরুষ সদস্যরা পালাতে পারেননি।
পাকিস্তানি সেনারা রাইফেলের বাট দিয়ে বাড়ির প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের ইঙ্গিতে তারা কুণ্ডুবাড়ির বিলাসবহুল সুরম্য ঘরটি ঘিরে ফেলে। তারা পর্যায়ক্রমে নৃপেন কুণ্ডু, নরেন্দ্র কুণ্ডু, নিরেন্দ্র কুণ্ডু (মিন্টু) এবং নরেশ কুণ্ডুকে ধরে হাতকড়া পরিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জনশূন্য কুণ্ডুবাড়ির প্রতিটি ঘরে তল্লাশি চালায়। তারা আলমারি ও সিন্ধুক ভেঙে স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নেয়।
লুটপাটের পাশাপাশি রাজাকাররা কুণ্ডুবাড়ির শাল-সেগুন কাঠের তৈরি সুরম্য ঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দ্রুত আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, যা গ্রামের মানুষের মনে আরও আতঙ্ক ছড়ায়। এছাড়া, কুণ্ডুবাড়ির শস্য গুদামে, যেখানে প্রায় এক হাজার মণ খেসারি, মাশকলাই, সরিষা ও ধান মজুত ছিল, সেখানেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ শস্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড
লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর পাকিস্তানি সেনারা কুণ্ডুবাড়ির চারজন সদস্য—নৃপেন কুণ্ডু, নরেন্দ্র কুণ্ডু, নিরেন্দ্র কুণ্ডু (মিন্টু) এবং নরেশ কুণ্ডুকে হাতকড়া পরিয়ে পানসি নৌকায় তুলে নিয়ে দৌলতপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন ও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
২৬ আগস্ট সন্ধ্যার পর তাদের বেউথা ঘাটে (মানিকগঞ্জ) একটি লঞ্চে তোলা হয়। লঞ্চটি হরিরামপুর থানার দিকে যাত্রা করে। পথে পাকিস্তানি সেনারা চারজনকে একে একে হাতকড়া খুলে সারিবদ্ধভাবে বেঁধে ফেলে। এই সময় নরেশ কুণ্ডু অন্ধকারাচ্ছন্ন লঞ্চ থেকে বাঁধন খুলে কালিগঙ্গা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে, অন্য তিনজন—নৃপেন কুণ্ডু, নরেন্দ্র কুণ্ডু এবং নিরেন্দ্র কুণ্ডু (মিন্টু)—এর ওপর পাকিস্তানি সেনারা উপর্যুপরি ব্রাশ ফায়ার চালায়। এই নৃশংস হামলায় তিনজনই নিহত হন।
নরেশ কুণ্ডু, যিনি নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, মৃতের মতো ভাসতে ভাসতে অজানা একটি গ্রামে পৌঁছে আশ্রয় নেন। সেখানে সুস্থ হয়ে তিনি ভারতে পাড়ি জমান। স্বাধীনতার পর তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন, কিন্তু তাঁর পরিবারের অন্য তিন সদস্যের নির্মম হত্যাকাণ্ড তাঁর জীবনে এবং গ্রামের ইতিহাসে চিরন্তন ক্ষত হিসেবে রয়ে যায়।
ঘটনার তাৎপর্য
কুণ্ডুবাড়ি হত্যাকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণের একটি নির্মম উদাহরণ। এই ঘটনা শুধু কুণ্ডু পরিবারের ধ্বংসই নয়, গ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। শস্য গুদাম পুড়িয়ে দেওয়া এবং মূল্যবান সম্পদ লুট করার মাধ্যমে হানাদাররা গ্রামের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে দেয়।
এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা গ্রামে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। তবে, নরেশ কুণ্ডুর প্রাণে বেঁচে যাওয়া এবং পরবর্তীতে ভারতে আশ্রয় নিয়ে ফিরে আসা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধের চেতনার একটি প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
কুণ্ডুবাড়ি হত্যাকাণ্ড ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের নৃশংসতার একটি চিত্র তুলে ধরে। এই ঘটনা বিষ্ণুপুর গ্রামের মানুষের জন্য একটি অবিস্মরণীয় ট্র্যাজেডি হলেও, এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাঙালির প্রতিরোধ ও সংগ্রামের ইতিহাসের একটি অংশ। নৃপেন কুণ্ডু, নরেন্দ্র কুণ্ডু এবং নিরেন্দ্র কুণ্ডুর আত্মত্যাগ এবং নরেশ কুণ্ডুর বেঁচে ফিরে আসা মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও সংগ্রামীদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
সূত্র
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ২য় খণ্ড
মো. আমিনুর রহমান
মন্তব্য করুন